একজন রাখালের কথা, কিংবা ভেড়া হবার আটটি ধাপ

ভূমিকাঃ
মানব সভ্যতার বয়স খুব বেশি না। আমরা জানি যে মানুষ চাষবাস শুরু করেছিল মোটামুটি ১০ হাজার বছর আগে, এভাবেই মানব সমাজ গড়ে উঠেছিল। এই স্বল্প সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা গেছে প্রায়ই কয়েকজন একত্র হয়ে দল বা জোট গড়ে তোলে। বৈচিত্র্যময় সমাজের মধ্যে তারা মূলত একটি নির্দিষ্ট মতবাদকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই মতবাদ সমাজের প্রচলিত এক বা একাধিক নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে। যেমন, এরকম দল বা জোটের একটি প্রচলিত উদাহরণ হলো ধর্ম। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে একেকটি ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। ছোট গোষ্ঠীতে কিছু প্রথা ও নিয়ম সৃষ্টির মাধ্যমে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার ভেতরেই ধর্মগুলো এক ধরণের পরিবর্তন সাধন করেছে। ক্রমেই মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থ কিংবা নিছকই কৌতূহল থেকে সেইসব নিয়মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, দল বা জোট বড়ো হয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, একটা সময়ের পরে ধর্মীয় জোটগুলো প্রকাণ্ড প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মানুষ নেতার জায়গা নিয়ে নেয় ধর্মের মতবাদ বা ডকট্রিন। তখন নতুন দীক্ষিত ব্যক্তিকে পুরাতন অনুসারীই সেই ডকট্রিনের শিক্ষা দিতে পারেন, আদি নেতার বা প্রবর্তকের দরকার পড়ে না। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উদ্ভব ঘটে।

এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন দল গড়ে ওঠে। এখানে উল্লেখ্য যে নিছকই বিনোদন বা শখের উদ্দেশ্য গড়া কোন দলের সাথে এখানে আলোচিত দলকে মিলিয়ে ফেললে ভুল হবে। বিনোদন বা শখের ভিত্তিতে গড়া দলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে মানুষের ফলিত চাহিদা পূরণ। সমাজের মূল কাঠামোকে বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত না করেও এসব দল তাদের কার্যক্রম চালাতে পারে। পাড়ায় বইপড়ুয়াদের দল, গানবাজনা দল, কিংবা মামুলি মুভি-থিয়েটার দেখা গোষ্ঠী এসব দলের আওতায় পড়ে। অন্যদিকে উপরে যে দলগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের বা চাহিদার উন্নয়নে সাহায্য করে। সমাজের বর্তমান অবস্থায় ব্যক্তি মানুষ যে সীমাবদ্ধতা অনুভব করে, নিজের উন্নতির সুযোগ না পেয়ে যে ব্যক্তি হতাশ, দুর্নীতি ও অনাচারের প্রতাপে যে ব্যক্তি অতিষ্ঠ, তাকে সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যও বিভিন্ন সময়ে এসব দল গড়ে ওঠে। এই দল হতে পারে রাজনৈতিক, হতে পারে ধার্মিক, হতে পারে আদর্শিক, অথবা এই সবকিছুর মিশেল। এসব ফলিত ও মৌলিক দলগুলোর মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলে উভয় দলে ব্যক্তির ভূমিকা। ফলিত শখের দলে প্রতিটি ব্যক্তিই নিজস্ব চর্চাকে লালন করতে পারেন, কিন্তু মৌলিক নিয়মের দলে নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিসর খুবই সংকীর্ণ।

অনেক সময়ই নির্দোষ ভেবে বুঝে ওঠার আগেই এমন দলের অংশ হয়ে যেতে পারি। তাই এসব দলের চরিত্র জানার পাশাপাশি এটাও জানা জরুরি যে, এদেরকে চিহ্নিত করার উপায় কী? প্রথমেই দেখতে হবে এরা ঠিক কীভাবে নতুন সদস্যকে দলে নেয়। একেক দলের কাজ করার প্রক্রিয়া একেক রকম, কিন্তু বিশ্লেষণ করলে মোটামুটি আটটি ধাপ পাওয়া যায়।

প্রথম ধাপঃ নির্দোষ দাওয়াত

কথায় বলে, উঠতি মুলো পত্তনে বোঝা যায়। দলে নেয়ার প্রথম পদক্ষেপই হচ্ছে সক্রিয় কর্মীদের কেউ আপনাকে কোন একটা অনুষ্ঠানে আসতে বলবে। না, তাদের বার্ষিক বা মাসিক গেট-টুগেদারে না। নেহাতই নির্দোষ এবং সাধারণ কোন অনুষ্ঠান হতে পারে সেটা। হতে পারে শুক্রবারের চায়ের দাওয়াত, হতে পারে ফেব্রুয়ারি মাসে বনভোজনে সাভার যাওয়ার দাওয়াত ইত্যাদি। শুরুতেই যদি বলে, “দিন-দুনিয়া পরিবার-স্বজন ছেড়ে দলে যোগ দাও”, তাহলে তো আপনি মানে মানে কেটে পড়বেন! এজন্য ‘বাজিয়ে’ দেখার জন্যেই প্রথমে নিরামিষ কোন অনুষ্ঠানে ডাকা হয় সম্ভাব্য নতুন সদস্যকে। এই ধাপটাকে চিহ্নিত করা খুবই কঠিন, নিতান্তই সন্দেহপ্রবণ মন না হলে ধরাও যায় না। কারণ অন্যান্য শখের বশে গড়ে ওঠা গ্রুপগুলোও এরকম ধরণের অনুষ্ঠানেই দাওয়াত দেয়। আপনার যদি আবৃত্তি করার শখ থাকে, কিংবা গান গাওয়ার শখ থাকে, তাহলে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডাকলে কি আপনি যাবেন না? আগ্রহী হবেন না? অবশ্যই হবেন। তারপরও চোখ-কান খোলা রাখতে হবে, কারণ এর পরের ধাপ থেকেই দুই ধারার দলগুলো আলাদা আচরণ করতে শুরু করে।

দ্বিতীয় ধাপঃ স্নেহ-ভালোবাসা কারে কয়?

অনুষ্ঠানের দাওয়াত তো নিলেন, সেজে-গুঁজে আগ্রহ নিয়ে গেলেনও। তারপর দেখলেন দলের পুরানো সদস্যরা দারুণ মাইডিয়ার টাইপের। সবাই হেসে হেসে কথা বলছে আপনার সাথে, আগ্রহ নিয়ে শুনছে আপনি কী বলেন বা ভাবেন, কয়েকজন বারবার খোঁজ নিচ্ছে আপনার কিছু লাগবে কি না, খাওয়া-দাওয়া আরামের ব্যবস্থা হচ্ছে কি না ইত্যাদি। আপনি তো মনে মনে এমন আদর পেয়ে লাটে উঠে যাচ্ছেন। আসলে খাতিরদারি কে না ভালোবাসে! আপনি যদি খুব আত্মকেন্দ্রিকও হন, তাও এমন মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলে, একটু একটু খুশিই লাগে। এর পেছনের সাইকোলজিটা হলো, দলের সদস্যরা সচেতনভাবে আপনার মনের স্মৃতি ট্যাম্পারিং করছে। আজকের দিনের ঘটনাবলীর সাথে ভালো লাগার বিরল অনুভূতিকে জুড়ে দিচ্ছে। দুয়েকমাস পরে যখন দলের কাজকর্মে বিরক্ত হতে যাইতেন, সেসময় এই প্রথম দিনের স্মৃতি মনে করে আপনার মনের বিরক্তি দূর হয়ে যাবে। মনে মনে নিজেকে বুঝাবেন, “আসলেই তো এরা কতো ভালো ব্যবহার করেছিল আমার সাথে!”, আর নিজেকে নিজেই দলের সাথে জুড়ে রাখবেন। অতো দূরের কথাই বা কেন বলি, প্রথম দিনের এই ভালো ব্যবহার ও আপ্যায়নের কারণেই পরের দাওয়াতে আপনি আগ্রহ নিয়ে অংশ নিবেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো সময়ের সাথে সাথে এই মেকি উচ্ছ্বসিত ব্যবহার ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে আপনি দলের অংশ হয়ে যাচ্ছেন, এবং পুরানো সদস্যরাও আপনাকে অন্য পন্থায় কব্জা করছে।

তৃতীয় ধাপঃ পুরষ্কারের মুলা, নাকের সামনে ঝুলা

ধীরে ধীরে বিভিন্ন দাওয়াতে যাওয়া-আসার মাধ্যমে সম্ভাব্য নতুন সদস্যের পরিচিতি ও স্বচ্ছন্দ বাড়তে থাকে। এর পরের পর্যায় থেকেই অপেক্ষাকৃত সিরিয়াস ধাপগুলো আসতে থাকে। আরেকটা ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো আপনার পক্ষে পুরোপুরি সম্পর্ক চুকিয়ে দল থেকে বেরিয়ে আসার এটাই নিরাপদতম পর্যায়। কারণ এর পরের ধাপগুলোতে যতই এগুবেন, দল ত্যাগ ততই ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে আপনার জন্য। এই ধাপে দলের এক বা একাধিক পুরনো সদস্য আপনাকে মহা-আরাধ্য কামনার বস্তু “পুরষ্কারের” কথা বলবেন। এই দলের মূল কার্যক্রম ব্যাখ্যা করবেন। দলের সাথে সম্পৃক্ত হলে আপনি কী কী সুবিধা পাবেন তা ধীরে ধীরে আকারে ইঙ্গিতে বা সরাসরি আপনাকে বলা হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা আপনার মানসিক বা সামাজিক দুর্বলতাকে টার্গেট করবে। এখানে লক্ষণীয় যে, এই পুরষ্কারের প্রতি যদি আপনার আগ্রহ না থাকে, তাহলে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো আর ঘটবে না। পুরষ্কারের বৈশিষ্ট্যকে আপনি মনে-প্রাণে কামনা করলেই শুধুমাত্র পরের ধাপ সামনে আসবে। অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষা জন্ম হতে হবে আপনার মনে, লক্ষ্য তারা তুলে ধরলেও আপনি এক বিভ্রান্তিতে থাকবেন যে এই লক্ষ্য আপনি নিজে নিজেই ঠিক করেছেন।

পরবর্তী ধাপে আপনি পিছু হটার চেষ্টা করলে পুরানো সদস্যরা একটু মনে করিয়ে দিবে যে এক সময় আপনি নিজেই এই লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন। নিজেই নিজের বিরোধিতা করা বা নিজেকে পরাস্ত করা হাজারগুণ কঠিন কাজ। তাই পুরাতন সদস্যদের এই সূক্ষ্ণ চালাকিটুকু আপনার দলে সামিল থাকার জন্য জরুরি।

চতুর্থ ধাপঃ দাও দাও, মোরে আরো দাও

পুরষ্কারের আশার পাশাপাশি আপনাকে বেশ কিছু সাফল্যের গল্প শোনানো হবে। অমুক আপনার মতই পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান থেকে এসে এই দলে যোগ দিয়েছিল। আপনার মতই সে এটা ওটা চাইতো। তারপর অনেক পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের ফলে সে একদিন সেটা অর্জন করতে পেরেছে। এখন তারা সুখে শান্তিতে বাস করছে। অমন সুখ কি আপনি পেতে চান? আপনিও কি চান তাদের মত সফলকাম হতে? যদি চান, তাহলে বলুন আপনি কীভাবে সেই পথে যাবেন? এরকম পর্যায়ে নতুন সদস্যের মনে যেন কিছুতেই দ্বিধার জন্ম না হয়, সেজন্য দলের পক্ষ থেকে এমন সফল কাউকে কাউকেও নিয়ে আসা হয়। স্বভাবতই তার বা তাদের সাথে কথা বলতে বলতে নতুন সদস্যের বিচার-ক্ষমতা প্রভাবিত হতে থাকে। উক্ত সফলদের সফলতাই যে তার নিজস্ব সফলতা নয়, কিংবা তারা যা বলছে সেটাও যে স্ক্রুটিনির প্রয়োজন আছে, সেটা নতুন আপনি চিন্তা করে দেখার সময়ই পাবেন না। ততদিনে আপনার সামনে সাফল্যের হাইওয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, এখন সময় দ্রুত সেই পথে ছোটার। আশেপাশে একটু জিরিয়ে চিন্তা করে দেখার সময় কই?

পঞ্চম ধাপঃ দল আগে, না তুমি আগে?

নতুন সদস্য হিসেবে আপনি অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন। দলের পুরানো সদস্যদের সাথে আপনার জোট যথেষ্টই দৃঢ়। বড়শি আপনি ভালোভাবেই গিলেছেন। এরকম “শিওর সাকসেস” অবস্থায় দলের কেউই চায় না আপনি ছুটে যান। এমনকি আপনিও যে পরিমাণ সময় ও চিন্তা লগ্নি করেছেন তাতে আপনিও চান না দলের বাইরে পড়তে। এই ধাপে এজন্য দল থেকে আপনার কাছে দাবি-দাওয়া আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। বেশি সময় ধরে দলের পেছনে দিতে হবে। এমন কিছু কাজ করতে হবে যেগুলো মন থেকে সায় দিতে পারবেন না। হয়তো আপনাকেই পাঠানো হবে নতুন সদস্য ধরে নিয়ে আসতে। এর মাঝে যদি আপনি বিন্দুমাত্রই উসখুস করেন, বাকিরা আপনাকে আল্টিমেট লক্ষ্যের কথা মনে করিয়ে দিবে। “এরকম ঢিলাঢালাভাবে চললে কখনই সফল হতে পারবে না”। এই পর্যায়ে আপনার যে কোন কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থতাকে বাজেভাবে ট্রিট করা হবে। শুরুর সেই মধুর আচরণ ভুলে যান, এখন আপনি দলের নিয়মকানুন মেনে না চললে যথেষ্ট বিপাকে পড়বেন।

হয়তো ভাবছেন এই ধাপেই তাহলে কেন বেরিয়ে আসবো না? বাস্তব হলো, বহু কারণেই আপনি বেরিয়ে আসতে পারবেন না। প্রথমত, আপনি নিজের অনেকটা সময় এই দলের সাথে দিয়ে ফেলেছেন। এটা আপনার দৈনন্দিন বা সাপ্তাহিক অভ্যাসের অংশ হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, দলের বিভিন্ন সদস্যের সাথে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক । এটা হুট করে কাটিয়ে দূরে সরে যাওয়া সম্ভব না। শুরুতে যখন আপনার ইনভলভমেন্ট কম ছিল, তখন সম্ভব হতো। কিন্তু এখন আপনি প্রায় প্রতিদিনই সবার সাথে দেখা করছেন, সবাই আপনাকে চেনে, জানে, বাসা-বাড়ি, কাজের জায়গা কোথায় এগুলো জানে। কেউ কেউ আপনার বাসায়ও এসেছে, আপনিও গেছেন তাদের বাসায়। এতোগুলো সম্পর্ক চাইলেই কাটানো যায় না। তৃতীয়ত, এই নতুন সম্পর্কগুলোর কারণে আপনার পুরানো বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন দূরে সরে গেছেন। আপনি নিজেই সরিয়ে দিয়েছিলেন এতোদিন। আজকালকার যুগে এসব সম্পর্ক মেরামত করা খুবই দুরূহ। চতুর্থত, আপনার নিজস্ব সফলতা বা সুখের লক্ষ্যটাকে পুরোপুরি বিসর্জন দিতে হবে। দলের ঠিক করা আইডিয়া লালন করতে করতে আপনি এখন নিজেকে তা থেকে আলাদা করতে পারেন না। এত বড়ো আত্মত্যাগ প্রায় কারো পক্ষেই সম্ভব হয় না।

ষষ্ঠ ধাপঃ অনুতাপের দহন

এই ধাপটি নতুন সদস্যের জন্য সবচেয়ে পীড়াদায়ক। আগের ধাপে ক্রমশ বেড়ে চলা দায়িত্ব ও টানাপোড়েন এই ধাপে এসে চূড়ান্ত রূপ নেয়। আপনার মনে দ্বিধা বাড়তে শুরু করেছে। বারবারই পুরানো দিনের কথা মনে পড়ছে, মন চাইছে এইসব ছেড়েছুঁড়ে ফেলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতে। কিন্তু এই পর্যায়েই দলার বাকি সদস্যরা আপনার হাবেভাবে বিরক্ত হতে শুরু করবে। ধীরে ধীরে তারা আপনাকে লজ্জা দিতে শুরু করবে। আপনি দলের প্রতি, আদর্শের প্রতি, মতবাদের প্রতি নিবেদিত নন – এই বিষয়টি উঠে আসবে। অনেকেই আপনার সাথে আগের সৌহার্য্যপূর্ণ সম্পর্ক শীতল করে দিবে। প্রায়ই আপনার উপস্থিতিকে উপেক্ষা করবে। সমসাময়িক সময়ে অন্য সদস্য যারা যোগ দিয়েছে, তাদের কাউকে কাউকে বেশি ফোকাস করা হবে, কারণ তারা দলের প্রতি অনেক বেশি নিয়োজিত। সাফল্যের পথে তারাই আছে, আপনি সরে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে আপনার মধ্যে জন্ম নিয়ে ব্যর্থতার অনুভূতি। এরকম পর্যায়ে আপনি মানসিকভাবে সম্পূর্ণই ভেঙে পড়বেন এবং স্বতন্ত্র চিন্তাগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন। আপনার মনে হবে, মতবাদকে প্রশ্ন করে ভুল করেছেন, মনে হবে দলের সবার কথা না শোনা ঠিক হয় নি। এটাও মনে হবে যে সেই পুরষ্কার আপনি ডিজার্ভ করেন না, দলের সাহায্যই আপনার একমাত্র সম্বল। তারাও এখন মুখ ফিরিয়ে নিলে আপনি আর কোনদিনই কিছু অর্জন করতে পারবেন না।

এই ধাপে আপনার শোচনীয় অবস্থা থেকে দল লাভবান হবে সবচেয়ে বেশি। কারণ এর ধাপের পরেই আপনি সম্পূর্ণভাবে এই মতের কেনা দাস হয়ে যাবেন। দলের সদস্যরা উঠতে বসলে উঠবেন। বসতে বললে বসবেন। কখনই অথরিটির কোন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার চিন্তাও আপনি আর মাথায় আনবেন।

সপ্তম ধাপঃ পুরষ্কার বনাম তিরষ্কার

ষষ্ঠ ধাপের অনুতাপের ভেতর দিয়ে যদি পার হতে পারেন, তাহলে এক পর্যায়ে দলের বাকিদের মতই আপনার “দলীয়করণ” সম্পন্ন হয়ে যাবে। প্রক্রিয়ার শুরুর আনন্দ ও উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে। মাঝের কার্যক্রম আপনাকে কর্মী হিসেবে গড়ে তুলেছে। আর কর্তাদের পদ্ধতিকে প্রশ্ন করার বা বিরোধিতা করার যৎসামান্য ইচ্ছা যা আপনার বাকি ছিল, তাও গত দুই ধাপে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। এখন আপনি দলের পোড় খাওয়া নিয়মিত অংশ। সবাইকে চেনেন, কী হয় না হয় জানেন। এই পর্যায়ে খুবই মৌলিক দুটো পথে সবকিছুকে বিচার করা হবে। আপনার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে পুরষ্কার, কলিগ ও পিয়ারদের কাছে শ্রদ্ধা-সম্মান-প্রশংসা। আর পালন করতে ব্যর্থ হলে ধমক-তিরষ্কার-তাচ্ছিল্য। আপনিও দল ছাড়বেন না ঐ পুরষ্কারের আশা আর শাস্তির ভয়ে। দলও আপনাকে ছাড়বে না কারণ সে আপনাকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নিতে পারবে।

অষ্টম ও শেষ ধাপঃ অস্তিত্ব ও পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ

এটাই মূলত আপনার ও দলের সম্পর্কের চূড়ান্ত পরিণতি। মতবাদ ও দল আপনাকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে। প্রতিটি কাজ আপনি সুষ্ঠুভাবে পালন করছেন। পুরানো সদস্যদের কাতারের কাছাকাছি চলে এসেছেন। দলে নতুন সদস্যদের কারো কারো দায়ভারও আপনার হাতে পড়ছে। নেতৃত্বের কাঠামোকে আপনি আর প্রশ্ন করেন না, হাতে যে কাজ দেয়া হয়, তার পেছনের কারণকেও আর প্রশ্ন করেন না।

তারপরেও অনেকে এতোগুলো পর্যায় পার হয়েও দল থেকে ছুটে যেতে পারে। সেজন্য আরো কিছু পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। কোন কোন দল তার সদস্যদের পারিবারিক সম্পর্কগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। দলের সদস্যই হয়ে ওঠে তার একমাত্র পরিবার। অন্য অনেক দলে সদস্যদের মাঝে কৃত্রিম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কে বেশি নিবেদিত তা প্রমাণের পরীক্ষা নেয়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন দলে বিভিন্ন পরিবেশে নানারকম উদ্ভাবনী উপায় কাজে লাগানো হয়।

তবে সেসব আরো বিস্তারিত ও বহুবিধ ব্যাপার। আমি নিজেও তার সবকিছু বুঝে উঠি নি। এইখানে মূলত ভেঙে ভেঙে দেখানো হলো যে আদর্শিক ও মতবাদভিত্তিক ক্রিয়াশীল দলগুলো কী উপায়ে মানুষকে দলের সদস্যে পরিণত করে। মোটা দাগে, কাউকে যদি এরকম খপ্পরে পড়ে সম্পূর্ণ বিপরীত মানুষে রূপান্তরিত হতে দেখেন, তাহলে বিচার করে দেখতে পারেন যে কীভাবে সে এই দলের খোঁজ পেল, এবং কীভাবে সে এই দলের সদস্যে পরিণত হলো। কম-বেশি এই আটটি ধাপ সহজেই চিহ্নিত করতে পারবেন।

৩২ টি মন্তব্য : “একজন রাখালের কথা, কিংবা ভেড়া হবার আটটি ধাপ”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    অনেক দিন পর লিখলেন ভাই! ব্রেইনওয়াশের চমৎকার আটটি ধাপ। টাইটেলগুলো নিয়ে একটি ফ্লো-চার্ট-কাভার-ফটো বানাবো কিনা চিন্তা করছি! 😀 নিজে জানুন, অপরকে জানান!


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    আমিতো দ্বিতীয় ধাপ থেকেই দু-দুবার ছিটকে বেড়িয়ে গেছি কপাল জোরে। অনেকেই তা পারে নাই।
    মনেপড়ে আমার এক বন্ধুকে চতুর্থ বা পঞ্চম ধাপ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। কি যে কষ্ট হয়েছে তাঁর ওখান থেকে বেরুতে...

    লিখাটা পড়ার সময় বার বার ঐ অভিজ্ঞতাগুলো ভেসে ভেসে আসছিল মনের পর্দায়.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      পারভেজ ভাই, ২য়, ৩য় ধাপে বের হয়ে আসা সহজ। আমি এরকম দুয়েকটা পরিস্থিতিতে বের হয়ে এসেছি। অর্ধেক বা তার বেশি পার হলে আসলেই অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। মানসিক, সামাজিক, আর্থিক, কখনো কখনো শারীরিক। কত বুদ্ধিদীপ্ত বারুদকে দেখেছি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে। খারাপ লাগে ভাবলে।

      জবাব দিন
  3. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂 🙂 🙂

    তোমার একজন সিক্রেট এডমায়রারের কাছে তোমার লেখালেখির গল্প শুনেছিলাম। আজ সিসিবিতে তোমায় পেয়ে চক্ষু কণর্ের বিবাদ মিটলো অবশেষে। নিয়মিত দেখতে চাই সিসিবিতে তোমাকে, ভাইয়া!

    গ্ল্যাড টু মিট ইউ ফাইনালি।

    জবাব দিন
      • নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

        আন্দালিব,
        আমি যখন সিসিবিতে আসি সেই ২০০৯ এ, তোমার কবিতা পড়েই এসেছিলাম। তোমার একটি লেখার মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে এসে নিজেই শেষে আটকে গেলাম। ছাইপাঁশ যা লিখি তাকে একে একে এখানে দিলাম, এবং পরে বহুবার এখানে দেবো সেই আনন্দে নতুন করে লিখলাম । এসবের পেছনেই তোমার একটি বড় ভূমিকা আছে -- আমারো তখন ব্রেক-আপ পর্ব চলছিল (অন্তত ৭/৮ বছর একটা লাইনও লিখিনি এমন অবস্থা) -- তখন তুমি উৎসাহ দিয়েছিলে। আমি সোৎসাহে সে উৎসাহ আঁকড়ে ধরেছিলাম। তোমাকে যতটুকু বুঝেছি --- তাতে এটুকু বুঝেছি, কবিতা তোমাকে ছাড়বেনা -- ফিরে ফিরে এসে জাপটে ধরবে। দেখো! এটা স্রেফ একটা phase
        আমি অপেক্ষায় থাকবো। সিসিবিও।

        জবাব দিন
  4. দারুন লেখা অনিক।
    সাথে এই ভিডিওটির সাক্ষাৎকারও দেখে নেয়া যেতে পারে যেখানে যুক্তরাজ্যের এক প্রাক্তন হিজবুত নেতা (যিনি পরবর্তী জীবনে একজন সন্ত্রাসবিরোধী গবেষক হয়েছেন) তার নিজের জঙ্গীবাদে জড়িত হওয়ার কারণগুলো বলছেন, এবং বলছেন কিভাবে তা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং কেন।

    http://www.abc.net.au/lateline/content/2015/s4262944.htm

    (১:০৬ থেকে দেখুন)

    জবাব দিন
  5. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    অ-নে-ক-দি-ন পরে লিখলে সিসিবি।

    যথারীতি দারুন পর্যবেক্ষণ। তবে আমি যদি ভুল বুঝে না-থাকি, তাহলে শেষটা মনে হলো খানিকটা নেতিবাচক। অর্থ্যাৎ, প্রথমোক্ত দলের সংস্পর্ষ এড়িয়ে চলা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তুমিই ত' উল্লেখ করেছো যে, সমাজের মৌলিক পরিবর্তন করতে হলে প্রথমোক্ত দলের মাধ্যমেই হতে হয়।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  6. মাহবুব (৭৮-৮৪)

    খুবই জরুরী একটা লেখা। তবে আমার মনে হয় মেষায়ন প্রকৃয়া সফল হবার পেছনে রাখালদের দাওয়াতি কর্মকান্ড যেমন, মেষ হবার আগ্রহও তেমন। অন্য জায়গায় যেমন বলেছিলাম- কিছু (নাকি বেশিরভাগ) মানুষই যেন কারো মুরীদ হবার জন্য মুখিয়ে থাকে।

    জবাব দিন
  7. নাফিস (২০০৪-১০)

    ২০০৮ সালে এসএসসি এর ছুটিতে গিয়ে রেটিনা-ফোকাস এর বেশ কিছু ফ্রি ইফতার এর দাওয়াত গ্রহণ করে ব্যাপক খানাপিনা করেছিলাম। আমার ডিফেন্স মেকানিজম তৈরি হয়ে গেছে ততদিনে। তাই ফাঁদে আটকে পড়ার টেনশন ছিল না।
    তাই, ফ্রি খানাপিনা মিস করতে মন চায় নাই 😛 এক ইফতারে কলেজের কিছু ফ্রেন্ডরা গিয়ে এমন খাওয়া দাওয়া দিয়েছিলাম যে খাবার শর্ট পরে গিয়েছিল। তেনারা এরপর বুঝতে পেরেছিল যে এই পার্টির " আত্মিক দাওয়াত" এ আগ্রহ নাই। এরা "খাই খাই" পার্টি 😀

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।