হৃৎপ্রাচীর

মাঝে মাঝে এমন ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ দিন আসে। ভোরের আলোর মোলায়েম পরশ থাকে না। স্লেটের মতো ছাইমাখা আকাশ ভয়ঙ্কর থমথমে চোখে চেয়ে থাকে। তার নিচেই ধাতব শীতল বাতাস এলোমেলো ঘুরতে থাকে। এমন দিনে রাস্তায় বেরুলে কোন মানুষ দেখবে না, দেখবে সারি সারি মৃত মুখ, নিস্প্রভ আলোহীন অবয়বে হেঁটে যাচ্ছে। সূর্যহীন আকাশের কারণে অবয়বগুলোর কোন ছায়া পড়ে না মাটিতে। তারা যেন মসৃণ কালো রাস্তার পাশ দিয়ে কিছুটা পিছলে পিছলে চলে যেতে থাকে। তোমাকে ছাড়িয়ে উঁচু উঁচু দালানগুলোও সেদিন ভেঙে চুরে আসে। তোমার মাথার ‘পরে দুমড়ে মুচড়ে পড়তে থাকে। তুমি দালানের সীমানা পেরিয়ে গেলে তারা আবার ঐ উঁচুতেই ফিরে যায়। তুমি পেছন ফিরে তাকালে দেখো স্লেটরঙা আকাশের জমিনে কালো খড়ের মতো সারি সারি দালান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তোমাকে দেখতে পেয়ে তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে থাকে। তাদের ধাতব শীতল শরীরে হরেক রঙের জানালা-চোখ তোমাকে দেখে ক্রূর ঠাট্টার স্বরে কথা বলে ওঠে। এমন দিনে রাস্তায় কোন সুন্দরীকে দেখে তোমার থমকে দাঁড়াতে ইচ্ছা হবে। তুমি ভাববে এক মুহূর্তের অবসর পেলে তার চোখের দিকে তাকাবো। ভাববে এলোবাতাসে তার পিঙ্গল চুল উড়ে বেড়ালে তুমি সেই সুবাস নিবে। হয়তো অনুমান করার চেষ্টা করবে মেয়েটি কোন শ্যাম্পু ব্যবহার করেছে। গারনিয়ের ফ্রুকটিস? প্যানটিন প্রো-ভি? নাকি তার চুল শক্ত করে বেণী করা। বাতাসে সেই চুল উড়বে না। তুমি তার সুবাসও পাবে না। তারপর তুমি ভাববে, মেয়েটির চেহারা এক ঝলক দেখতে পারলে মন্দ হতো না। একটু এগিয়ে তার মুখের দিকে তাকালে দেখবে চাঁদের ক্ষতের মতো পোড়া পোড়া গর্ত। সে গর্তের ভেতর দিয়ে তুমি দেখবে তার খুলির ভেতরে কিলবিল করছে হলদে হলদে ম্যাগট। তার মুখ গহ্বর থেকে আমিষের আঁষটে গন্ধ এসে ধাক্কা দেবে তোমার নাকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তুমি বুঝবে মেয়েটি মারা গেছে কয়েকশ বছর আগেই। তার জীবন্মৃত দেহ গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে। তার ভেতরে কোন স্বপ্ন নেই, সুখ নেই, হতাশা নেই, কামনা নেই। তোমার বুক ভেঙে যাবে। মনে হবে তাকে আলতো করে তুলে নিই। কোমল আদরে দু’হাতে ধরে শুইয়ে দিই কোন সবুজ বৃক্ষের তলে। চিরহরিৎ গুল্মের পরতে ঢেকে দেই তার বিশুষ্ক দেহ। বৃক্ষের শেকড়ে জড়িয়ে মিশে যাক তার পিঙ্গল চুল। তারপর তোমার চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু নামুক বৃষ্টি হয়ে। কিন্তু তোমার এই সাধ পূর্ণ হবে না। ভেবেচিন্তে কিছু করার আগেই মেয়েটি আরো অজস্র মেয়ের ভিড়ে হারিয়ে যাবে। নানারকম নানারঙের মেয়েদের দঙ্গল দেখবে দূর থেকে দূরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের পাশে পাশে দেখবে আরো অজস্র পুরুষ ছিন্নভিন্ন কঙ্কাল আঁকড়ে ধরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর এদের সকলের ওপরে স্লেটের মতো আকাশ। ঝঞ্ঝার মতো মেঘ। ধাতব সীসার মতো বাতাস। সূর্যহীন অবিশ্রান্ত দিন।

আর ঘরের দরজা খুলে আয়নায় নিজের ক্লান্ত মুখ দেখবে চাইবে। কিন্তু তুমি ঘর খুঁজে পাবে না। ঠিকানাটা ঠিকঠাক মনে থাকলেও সেই ঠিকানায় গিয়ে দেখবে ঘর নেই। সেখানে কৃষ্ণগহ্বরের শূন্যতা। নিজের ক্লান্ত মুখ তোমার আর দেখা হবে না। দু’হাতের আঙুলে হাতড়ে হাতড়ে মুখে বুলিয়ে বুঝতে চাইবে কতোটা নোনাজলের দাগ, পলিমাটির ধুলো সেই মুখে লেগে আছে।

আর তোমার খুব ঘুমাতে ইচ্ছা করবে। কিন্তু ঠিক তখনই হাতের আঙুলে ছুঁয়ে দেখতে পাবে তোমার অক্ষিকোটর শূন্য। সেখানে স্বপ্ন নেই। স্বপ্ন নেই, সুখ নেই, হতাশা নেই, কামনা নেই। ঘুম নেই।

১,৬০৬ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “হৃৎপ্রাচীর”

  1. জিহাদ (৯৯-০৫)

    অনেকদিন পর আপনাকে সিসিবিতে দেখে ভালু লাগলো 😀
    আর আপনার লেখা সম্পর্কে কী আর কইতাম, তাইফুর ভাই হইলে না হয় কিছু একটা বলে যাইতাম! :shy:


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আন্দালিব (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।