অর্থহীনালাপ

আমি আমার বন্ধুদের অতীত অবয়বগুলোর জন্য প্রবল আকুতি ও বেদনাবোধ করি।

তাদের বর্তমান অবয়ব আমার সাথে মেলে না। শুধু অমিলই না, রীতিমত বিপরীত প্রবণতা দেখি তাদের ভেতরে। এজন্য আমি প্রথম প্রথম খুব ক্ষুব্ধ হতাম। কারণ অতি-পরিচিত এই বন্ধুদের সাথেই তো বেড়ে উঠেছি। আমার সত্ত্বার সাথে তারা মিশে আছে। আমার চিন্তাভাবনার অনেকটাই তাদের ঘিরে গড়ে উঠেছে। এখন হয়তো আমার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু আমি বেড়ে ওঠার সময়টায় তাদের প্রভাবকে কখনই অস্বীকার করি না। অথচ এখন পৃথক ব্যক্তিত্বের কারণে দেখি যে তাদের সাথে আমার মানসিক দূরত্ব যোজন যোজনের। এরকম দূরত্বের কারণে প্রায়ই সম্পর্ক খারাপ হয়। দেখা যায় বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত থেকে তর্ক, সেই তর্ক শেষ হয় কথা বন্ধে। যেহেতু আলাপটা সামনাসামনি না, সেহেতু মীমাংসা হয় না। আমার ধারণা মুখোমুখি আলাপে আমি যতোটা মিশুক বা নমনীয়, ভার্চুয়াল জগতে ততোটা না। তাই বিকট তর্কের শেষে সম্পর্কটা টানাপোড়েনে পড়ে যায়। ভার্চুয়াল জগতের কারণে একটা ভ্রান্তিও কাজ করে, যার কারণে এই ক্ষতিটা গায়ে লাগে না। অবধারিতভাবে আমি ব্যস্ত হয়ে যাই আমার জীবনযাপনে। তারা ব্যস্ত হয়ে যায় তাদের জীবনে। হয়তো অনেকদিন পর খেয়াল করি যে সেই বন্ধুদের সাথে আর কোন আলাপের বিষয়ও নেই। তাদের বর্তমান চেহারাটা এতোটাই অপরিচিত লাগে যে আমি বুঝতেও পারি না কীভাবে পুনরায় যোগাযোগ করা যায়। আমি নিশ্চিত, আমার চেহারাটাও তাদের কাছে অচেনা লাগে। এভাবে অনেকগুলো অপরিচিত মানুষ আমার চারপাশ ঘিরে রাখে। প্রতিটা মানুষের পুরানো একটা রূপ আমার খুব প্রিয়, নানা কারণে। সেই রূপগুলো আর ফিরে পাই না। আস্তে আস্তে স্মৃতিও ফিকে হতে শুরু করবে। ভালো হতো যদি তাদের বর্তমান রূপের স্মৃতি ফিকে হতো, আর পুরানো স্মৃতিগুলো টিকে থাকতো। কিন্তু ঘটে উল্টোটা। নতুন রূপ এসে হটিয়ে দেয় পুরানো রূপ।

আজকাল রাতের খাবার একটু আগে আগে খেয়ে নিই, সন্ধ্যা হতেই। সন্ধ্যার পরের সময়টা একটু লম্বা হয়ে যায় এতে। কাজকর্ম বাকি থাকলে সেরে ফেলা যায়। মাঝে মাঝে এরকম বিদেশ বিভুঁইয়ে বসে দেশের কথা ভাবি। দেশ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আমার কাছে দেশ ছেড়ে আসার চেহারাটাই স্থির হয়ে আছে। দেশের পরিবর্তন কল্পনায় যেমন ভাবি, সেভাবে নিশ্চয়ই ঘটছে না। যেভাবে যা ঘটছে, সেগুলোর একটা বিশেষ চেহারা অনলাইন থেকে দেখতে পাচ্ছি। হয়তো খবরের ওয়েবসাইটে, কিংবা টিভির খবরের ভিডিওতে, কিংবা ফেসবুকের মাধ্যমে। এগুলো আসলে খণ্ডিত অংশ। এবং আমার নিজের চিন্তাভাবনায় সেগুলোর প্রবেশ ঘটে নিজের মতো একটা অবয়ব দাঁড় করাচ্ছে যা বাস্তব থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য। এটা আমি একেবারেই মেনে নিতে পারছি না।

আমার কাছে বিদেশ একটা ছন্নছাড়া অনুভূতি ছাড়া কিছুই না। ছোটবেলা থেকে বাইরে বাইরে থাকার কারণে অভিযোজিত হতে সময় লাগে নি। আর পশ্চিমা বিনোদনের সুবাদে অনেক কিছুই পূর্বপরিচিত ছিল। যে সংগ্রাম বা সয়ে নেয়া, সেটাও অভ্যাস হয়ে গিয়েছে দ্রুতই। কিন্তু দেশের জন্য পেট পোড়া কমছে না। একটা ভাগ হলো বাবা-মা-বোন এবং সংসারের সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর সাথে সাময়িক বিচ্ছেদের কষ্ট, আরেকটা ভাগ হলো দেশে থাকার আপন স্বস্তি। জ্যাম ঠেলে বইমেলায় যাওয়া, কিংবা কোন কাজে শাহবাগের আশেপাশে গেলে আজিজে একটু আড্ডা দেয়া, অথবা অফিসের পরে বাসায় ফিরে মিরপুরের আড্ডা। মজার ব্যাপার হলো এই ভাগটা ভার্চুয়াল জগতের কারণেই তৈরি হয়েছে। আরো মজার ব্যাপার হলো এই জগতের পরিচিত আপন আপন লাগা মানুষগুলোর সাথে যতো আত্মিক যোগাযোগ বেড়েছে, ততোই আমার পুরানো বন্ধুদের নতুন অবয়বের সাথে দূরত্ব বেড়ে গেছে। সমান্তরাল মসৃণ প্রক্রিয়া।

এগুলো আসলে অভিযোগের মতো শোনালেও আসলে তা নয়। আমি ভাগ্যবান যে বিদেশ আমার ভেতর লালসা তৈরি করতে পারছে না। বিদেশের প্রতি জঘন্য লাগার অনুভূতিটা দিনে দিনে বাড়ছে। একইসাথে দেশে ফিরে থিতু হবার আকর্ষণটাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এটা ভাল লক্ষণ। আমি চাই না এই দেশে বাকি জীবন কাটাতে। মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লে গাঢ় ঘুম হয়। সেই ঘুমের ভেতরেই ঢাকা শহরকে দেখি। ঢাকার রোদ। ধুলা। জ্যাম। ভিড়। ধাক্কা। যখন ফিরে যাবো ঢাকা আরো অনেক বদলে যাবে। ঢাকায় আরো কয়েক বছর থেকে একদিন মৃত্যুও হবে। আমার হাড়মাংস মিশে যাবে ঢাকার মাটিতে, যে মাটি থেকে জন্মেছিলাম, সেখানে ফিরে যাবো। চক্র পূর্ণ।

১,৪০৯ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “অর্থহীনালাপ”

  1. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    আমি তো তিনমাস পরেই কবে ঢাকা ফিরবো তার জন্য আক্ষরিক অর্থে আর কয়দিন বাকি সেটার হিসেব করতাম। অথচ ঢাকায় থাকতে কখনও ভাবি নি, এই জাহান্নামকে আদৌ কেউ এভাবে 'মিস' করতে পারে। যাই হোক, তবে এমন ফেজ নাকি কেটে যায়। বৈদেশে অনেকদিন থাকলে সেখানে শেকড় গজাতে বাধ্য, তাছাড়া দেশের বাস্তবতায় অনেকেরই ফিরে আসার ইচ্ছা থাকলে শেষমেষ সেটা আর করা হয় না পরিস্থিতির চাপে।

    আশা করি, আপনার ক্ষেত্রে তেমন হবে না 🙂

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      রায়হান, আমি ঢাকায় থাকতেও ছেড়ে আসতে চাই নাই কখনো। হয়তো কথাটা তোমার কাছে ভাবালু বা বানানো মনে হতে পারে। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে হয়তো গালাগালি করতাম অসহ্য হলে। কিন্তু সেটা সাময়িক। অন্য কোথাও বসবাস করে জীবন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব না।

      দেশে ফিরে অনেক কিছুর সাথেই নতুন করে মানিয়ে নিতে হবে। বিদেশে যে সচ্ছলতা, সেটা পাবো না জানি। রক্ত চড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও অহরহ ঘটবে বলে জানি। কিন্তু তারপরেও ঢাকার মায়া ছাড়ানো মুশকিল অল্প কয়টা বছরই তো, না হয় একটু 'ম্যানেজ' করেই নিলাম। 🙂

      তোমার আশার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক!

      জবাব দিন
  2. নাফিস (২০০৪-১০)

    আমি দিন গুনছি সেই কবে থেকে। অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না... খুব তাড়াতাড়ি শেষ ও হচ্ছেনা 🙁 এগুলো বোঝানো কঠিন সবাইকে।

    যাই হোক,কত দিন পরে লিখলেন ? ১ বছরের উপরে মনে হয়..
    আন্দালিব ভাই এর আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম। 😀

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      হ্যাঁ এক বছরের একটু বেশি সময় পরে লিখলাম। 🙂

      যারা দেশে থাকে, যন্ত্রণায় থাকে, তাদের পক্ষে না বোঝাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা বিদেশে স্বচ্ছন্দে থাকছে, তাদেরকে নিয়েই যতো সমস্যা। তারা আশা করে যে আমিও তাদের মতোই এখানে থিতু হয়ে যাবো। দেশে ফিরে যাওয়ার অপশনটা যেন তাদের মাথাতেই ঢোকে না!

      জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এতদিন পর! ঘরের ছেলে সুন্দর মত ঘরে ফিরে আয়, এই কামনা করি 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  4. দিবস (২০০২-২০০৮)
    আমার ধারণা মুখোমুখি আলাপে আমি যতোটা মিশুক বা নমনীয়, ভার্চুয়াল জগতে ততোটা না

    আমার ক্ষেত্রেও কথাটা এমন। অনেকের সাথে দুরত্ব তৈরী হয়েছে ভার্চুয়াল জগতের তর্ক-বিতর্ক নিয়ে। বিশেষ করে গত এক বছরে। তবে আমি আমার জায়গায় নিজেকে এখনও সঠিক দাবী করি এখনও। ভার্চুয়াল জগত আর সত্যিকার জগতের মধ্যে পার্থক্য পাই। ঢাকার কথাটা সঠিক বলতে পারব না। আমার মফস্বল শহর টাঙ্গাইলে ফেইসবুকের খুব বেশী প্রভাব আমি লক্ষ্য করি না। আর কিছু মানুষ ভার্চুয়াল জগতে অনেক সুন্দর কথা বললেও বাস্তবে সেই ধরণের মনমানসিকতাও ধারণ করার দায়িত্বটুকু রাখে না।

    ধার-দেনা করে প্রতি সেমিস্টার ব্রেকেই দেশে যাচ্ছি এ পর্যন্ত, প্রতিবার বলে আসি আর আসব না, থাকতে পারি না। সাড়ে চার মাস পরে যেয়েই অনেক ধরনের পরিবর্তন দেখি। আমার শুরুটা হয় চার মাস আগে রেখে যাওয়া সময় থেকেই। ততদিনে রাস্তা-ঘাট, মানুষজন এমনকি অটোরিকশার সংখ্যাও আমাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। ঠিক করেছি বিদেশে শিকড় গাড়তে দিব না। প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াতে দিব না বিদেশে থাকাটা। বাকীটা সময়ের হাতে ছেড়ে দিলাম।

    অনেকদিন পর ব্লগে লিখলেন। একসময় আপনাদের দেখে সিসিবিকে বাড়িঘর বানিয়ে ফেলেছিলাম। অনেকদিন পর দেখে কেমন যেন আনন্দের চক্র পূর্ণ হল কিছুটা হলেও।


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
  5. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    আন্দালিব,

    মেলা দিন পরে লিখলে। প্রথমে কবিতা ভেবে এড়িয়ে গেছি, কবিতা বুঝিনা বলে। পরে এসে দেখি, বিষয় ভিন্ন 🙂

    আমার ধারণা মুখোমুখি আলাপে আমি যতোটা মিশুক বা নমনীয়, ভার্চুয়াল জগতে ততোটা না। তাই বিকট তর্কের শেষে সম্পর্কটা টানাপোড়েনে পড়ে যায়। ভার্চুয়াল জগতের কারণে একটা ভ্রান্তিও কাজ করে, যার কারণে এই ক্ষতিটা গায়ে লাগে না। অবধারিতভাবে আমি ব্যস্ত হয়ে যাই আমার জীবনযাপনে। তারা ব্যস্ত হয়ে যায় তাদের জীবনে।

    ভার্চুয়াল জগৎ কিন্তু বাস্তব নয়। কাজেই, ঠকলে সেখানে ঠকাই ভালো, বাস্তবতাকে অটুট রেখে। এই বিশ্বাসের জন্যই ফেসবুককে চিরবিদায় জানিয়েছি :grr:

    যখন ফিরে যাবো ঢাকা আরো অনেক বদলে যাবে। ঢাকায় আরো কয়েক বছর থেকে একদিন মৃত্যুও হবে। আমার হাড়মাংস মিশে যাবে ঢাকার মাটিতে, যে মাটি থেকে জন্মেছিলাম, সেখানে ফিরে যাবো। চক্র পূর্ণ।

    তোমাকে ছোটভাই মনে করার পরও এইখানে তোমাকে রীতিমত ঈর্ষা করছি। জীবনে সবথেকে বেশি চেয়েছিলাম যা' হতে (ঢাবি'র শিক্ষক), দিন দিন সেটা চলে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে। আন্তির্জাতিক জার্নালে একেকটা আর্টিক্যাল পাবলিশ হচ্ছে, আর আমি জেনে যাচ্ছি দেশের সাথে আমার মধ্যকার বাঁধার দেওয়ালটা পুরু হয়ে উঠছে। (কেন, কিভাবে সেটা অনুমান করে নিও)। দেশান্তরী হওয়ার এই হাহাকার নিয়ে বেঁচে থাকাই মনে হচ্ছে আমার অমোঘ নিয়তি ~x(


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      আসলে সবই ট্রেড-অফ। আমি কেয়ার করি না আমার গবেষণার ফলাফল জার্নালে পাবলিশ করতেই হবে। পিএইচডি করাটাকে আমি আসলেই একটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যম ধরে নিয়েছি। প্রফেসরটাও ভাল, যে পেপার পাবলিশ করা নিয়ে তাগাদা দেয় না।

      আমার মধ্যে ক্যারিয়ার নিয়ে মাথাব্যথা, টাকাপয়সা নিয়ে দুশ্চিন্তা একেবারেই কম। এটাও একটা কারণ। আমি বন্ধুবান্ধবদের 'সাফল্য' (টাকা বা ক্যারিয়ার) দেখে অতোটা বিচলিতও হই না। ইঁদুর দৌড়ে অনীহাও একটা কারণ। সব মিলিয়ে আমার জন্য দেশে ফেরা অনেক সহজ। আমার বন্ধুদের দেখে বুঝতে পারি যে তাদের জন্য অতোটা সহজ নয়।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : দিবস (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।