শাহবাগ ভাবনা

ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে ভেবেছিলাম বইমেলায় যেতে পারবো না এটা এই মাসে সবচেয়ে বড়ো আফসোস হয়ে থাকবে। ৫ তারিখের পর থেকে সব উল্টেপাল্টে গেল! শাহবাগে সশরীরে থাকতে না পারা, এমনকি মাঝে মাঝে কাজের চাপে ভার্চুয়ালিও থাকতে না পারা আমার জন্য প্রবল আফসোস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমি পেশা হিসেবে শিক্ষকতা করবো বলে ঠিক করেছি প্রায় বছর দুয়েক আগে। দেশের একটা প্রায়-অখ্যাত, থার্ড টিয়ার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তড়িৎ কৌশল পড়াতাম। পড়াতে পড়াতে টের পেলাম যে এই বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই কম। ছাত্রদের হয়তো কোচিং সেন্টারের মত বই আউড়ে দিতে পারি, কিন্তু সত্যিকার অর্থেই বিষয়টা তাকে বুঝানো লাগবে, তত্ত্বের সাথে বাস্তব দুনিয়ার সংযোগটা দেখিয়ে দিতে হবে; সে বিদ্যা আমার নেই। কেবল সূত্র মুখস্ত করে আর অঙ্ক করে তারা হয়তো ভাল গ্রেড পেতে পারে, কিন্তু চাকরিক্ষেত্রে গিয়ে সামান্য অ্যাপ্লিকেশনগুলোতেই আটকে যাবে। আরো একটা ব্যাপারে আমার প্রশিক্ষণ দরকার আছে – সেটা হলো ছাত্রদের মাঝে দায়িত্ববোধের জন্ম দেয়া এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য গড়ে তোলা। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো সাধারণত মানুষ বাবা-মা কিংবা বড় ভাই-বোন ও আত্মীয়দের কাছ থেকে শিখে নেয়। কিন্তু বাঙলাদেশে জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত বাবা-মায়ের পক্ষে সন্তানদের ভরণ-পোষণের পর এত সূক্ষ্ণ অথচ জরুরি বিষয়গুলো শেখানোর অবকাশ থাকে না। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও এই বিষয়গুলোতে নজর দিতে পারে না। এই শিক্ষাটি কেবল ভাগ্যবান ছাত্রদের কপালে জোটে, যারা সেই প্রজ্ঞাবান শিক্ষকদের সংস্পর্শ পায়। আমি কলেজে পড়ার সময় তেমন শিক্ষকদের পেয়েছিলাম, যারা পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের জগতকে বুঝার দৃষ্টি খুলে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন আমার ভেতর।

ভালোকে খারাপ থেকে আলাদা করতে পারার বিবেচনা, ঝাঁকের কইয়ের মতো জনপ্রিয় মতের তরফে চিন্তাভাবনা ছাড়াই না দাঁড়িয়ে প্রয়োজনে বিরুদ্ধমতকে সোচ্চার করার সাহস থাকা প্রয়োজন। এগুলো একজন দায়িত্ববান মানুষ তথা সুনাগরিক গড়ে তোলে। যে ব্যক্তি নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারেন এবং সেই মতকে সমুন্নত রাখতে এবং মানুষের হিতার্থে প্রয়োগ করতে যে কোন শক্তির মোকাবিলা করার সাহস রাখেন, তিনিই মহোত্তম। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, এই সাহস কখনই মুখে বলে দেখানোর সাহস নয়। সামাজিক যোগাযোগে এমন মানুষই বেশি যারা মুখে মুখে অনেক হাতি-ঘোড়া মেরে বসেন, কিন্তু স্থির পরিকল্পনা ও একগুঁয়ের মত একাগ্রতা নিয়ে নিজের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন না। আমরাও এমন চটক আর জেল্লা দেখে ভুল করে তাকেই ‘নায়ক’ মনে করি। যদিও মূলত তিনি বাক্যসর্বস্ব মানুষ, দায়িত্ব নিতে জানেন না। উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যের জন্য যদি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার চর্চা নাগরিক জীবনে থাকতো, তাহলে আমরা দেখতাম এই মুখে মুখে হাতি-ঘোড়া মারা মানুষগুলো চুপ মেরে গেছেন!

আমি মনে করি একজন ছাত্রের সম্ভাবনা অসীম। অতিক্ষুদ্র শিক্ষকতাজীবনে এমন দুরন্ত ছাত্র দেখেছি, যে নিতান্ত সাধারণ পড়াশোনার মান পেয়েও তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে। আমি নিজেই তাদের শেখার ক্ষমতা ও শিক্ষাকে কাজে লাগানোর দক্ষতা দেখে আশাবাদী হয়েছি। গর্বও হয়েছে যে প্রায় কাছাকাছি বয়সের এমন কাউকে শেখানোর সুযোগ পেয়েছি, যদিও আমি তার থেকে অনেক কম জানি। আবার বেদনার্ত হয়ে দেখেছি কিছু কিছু ছাত্র নিজের অমিত সম্ভাবনাকে অনেকটা না বুঝেই অপচয় করছে। তারা বিদ্যার্জন করছে, কিন্তু তা কেবল নিজের ক্যারিয়ারের স্বার্থে। অস্বীকার করবার উপায় নেই যে অনেকের বাস্তবতা সুখের নয়, হয়তো পারিবারিক দায়বদ্ধতা তাদের ওপর চেপে বসেছে। তাদের দোষ দেখি না। তবে খারাপ লাগে যে এমন সম্ভাবনাময় একজন মানুষকে বেড়ে ওঠার, নিজের পছন্দের ক্ষেত্রে বিকশিত হবার সুযোগ সমাজ দিচ্ছে না দেখে। আমি ভেবেছিলাম যে এই কঠোর বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই।

তবে এই শাহবাগ গণজাগরণ আমার সেই ধারণাকে বদলে দিচ্ছে ক্রমশ। আমি এখন মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে একজন মানুষ তার বাস্তবতাকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের চাপিয়ে দেয়া নিয়মকে অবলীলায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার অমিত শক্তি তার ভেতর সঞ্চিত ও সুপ্ত রয়েছে। দরকার কেবল একটু স্ফূলিঙ্গের, আর একটু যূথবদ্ধতার। আদালতের রায় মেনে না নিয়ে যে গুটিকয় মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তারা আমাদের সবার মতোই সাধারণ মানুষ। জামাত-শিবির ছাড়া ওইদিন রায়ের সংবাদে কম-বেশি সবাই আমরা ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলাম। চিন্তা করে দেখুন, ওই কয়েকজন এগিয়ে এসে না বসলে, দায়িত্ব নিয়ে ঘোষণা না দিলে হয়ত এই আন্দোলনের জন্মই হতো না! গুটিকয় মানুষ রাজপথে বসে পড়লেন, একদিন পরেই সেই গুটিকয় মানুষ হয়ে গেল জনসমুদ্র। এখানে উল্লেখ্য যে জনসমুদ্রের সকলেরই দায়িত্ববোধ প্রথমে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর দায়িত্ববোধের সমান। আমরা নেতাপ্রবণ জাতি, কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে কোন নেতা জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে আমাদের যুদ্ধগুলো করে দেন নি। মানুষ নিজের যুদ্ধ নিজেই করেছে। তেমনি শাহবাগের প্রতিদিনের অসংখ্য মানুষের বিন্দু বিন্দু স্বতন্ত্র চেতনাই এই গণজাগরণের জ্বালানি। আমার আফসোস, এই স্ফূরিত আগুন আমি নিজ চোখে দেখতে পেলাম না, কেবল মনিটরেই দেখলাম।

এই যুদ্ধে আমাদের শত্রু সংখ্যায় দুর্বল। কিন্তু তারা সঙ্ঘবদ্ধ। আমরা সংখ্যায় বহুগুণ। কিন্তু একতাবদ্ধ নই। মাত্র সতেরো দিনের আন্দোলনে আমাদের মাঝে কিছু কিছু মতবিরোধ, চাপাক্ষোভ, মনমালিন্য তৈরি হয়েছে। মাথা গরম না করে চিন্তা করে দেখুন তো, এর পেছনে যাকে দায়ী করছেন, তার মতো আপনি নিজেও কি সমানভাবে দায়ী নন? আন্দোলনের প্রথম দিনের আপনি কি ভেবেছিলেন যে সতেরো দিন পরে এরকম কিছু হতে পারে? কিংবা চিন্তা করুন, যে তিল তিল ত্যাগের মাধ্যমে এই গণজাগরণের অনল ছড়িয়ে গেছে, সেখানে আপনার বা আমার ব্যক্তিগত চাওয়াপাওয়ার গুরুত্ব কতটুকু? নেই বললেই চলে। এর পরেও যদি মনে করেন যে আপনার রাগ বা হতাশা যৌক্তিক, তাহলে একাত্তরে ফিরে যাই, চলুন। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট হলো। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা। তার সতেরো দিন পরের তারিখ হলো ১২ এপ্রিল। মাত্র দুইদিন হলো বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছে! জানেন তো, সেই সরকার গঠনের সময় নিজের স্বার্থ নিয়ে নিচুমনের কাইজ্যা কে লাগিয়েছিল? লোকটার নাম খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ইতিহাস তাকে তার জায়গা দেখিয়ে দিয়েছে।

তাই বলি, ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে ওঠার ক্ষমতা আপনার আছে, জাতি খন্দকার মোশতাক চায় না, বরং স্থিতধী তাজউদ্দিন আহমদ চায়। শত্রু আমাদের চাইতে সঙ্ঘবদ্ধ, কারণ তাদের লক্ষ্য স্থিরকৃত। আমাদের লক্ষ্য স্থির করা হলে সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ না করে একাত্ম হোন। এটা অমন হলে ভাল হতো, ওটা তেমন হলে ঠিক হতো – এরকম সমালোচনার উদ্রেক হচ্ছে কারণ যখন এটা এবং ওটা ঠিক করা হয়েছে তখন আপনি সক্রিয় ছিলেন না। দায়িত্ব নেন নি। তাই এখন আপনার দায়িত্ব হলো যারা দায়িত্ব নিয়েছে তাদেরকে সমর্থন দেয়া। এই নির্দেশনার কোনকিছু আপনার অপছন্দ হতেই পারে। সেক্ষেত্রে সক্রিয় হয়ে পরের ধাপগুলোকে বাস্তবায়নে অংশ নিন, দেখবেন তখন আপনার নির্দেশনা ও পরামর্শ গৃহীত হচ্ছে। আমাদের শত্রুরা চায় আমাদের মাঝে এই মতবিরোধ লেগে থাকুক, ক্রমেই বেড়ে উঠুক। কারণ একমাত্র এই স্ট্র্যাটেজিতেই তারা জিততে পারবে। আমাদের জনবল প্রচুর, কেবল দরকার মতামত নির্বিশেষে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে দৃষ্টিনিবদ্ধ রাখা।

জয় বাংলা!

১,০৮৯ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “শাহবাগ ভাবনা”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    শাহবাগে সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারার আক্ষেপ আমাকেও পোড়াবে আজীবন।আমরা যে চাইলেই পারি, সংঘবদ্ধতার দিন ও ক্ষমতা যে সাধারণ মানুষের এখনো ফুরিয়ে যায়নি এটা জানা আমাদের নিজেদের জন্যে খুব দরকার ছিলো।প্রত্যেকের ব্যক্তিগত স্ফুলিংগ ধিকিধিকি জ্বলছিলো, নিঃশেষ হয়ে এসেছিলো এমনটা মনে হচ্ছিলো - কিন্তু শাহবাগের পর বাংলাদেশ যে আর সেই বাংলাদেশ যে রইলোনা, এটাই আমাদের মূল অর্জন। এখন আমাদের অনেক কঠিন সময় পার হতে হবে - শাহবাগের অহিংস কিন্তু অনড় অবস্থানের বিপরীতে জামাত-শিবিরের উগ্র ঔদ্ধত্য তাই বলে।

    আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা দেখেছি, শিবির কিভাবে নিজেদের রগকাটা চরিত্রকে একটু একটু করে একটা ভদ্র মুখোশ পরানোর চেষ্টায় রত ছিলো, সাধারণ ছাত্রদের এটা বোঝানোর জন্যে যে, স্মার্ট ছাত্ররাও শিবির করে ( বা শিবিরের ছেলেরাও স্মার্ট হয় - জিন্স পরে, প্রেম করে, সিগারেট মদ খায় ব্যাণ্ডের গান শোনে, শেভ করে)।
    অথচ তাদের সাংগঠনিক কার্যকলাপ, দর্শন একটুও পাল্টায়নি -- ভেতরে ভেতরে তারা সেই রগকাটার সংস্কৃতিরই লালনকারী শুধু। মিঠে কথার আড়ালে একটু ভয় মিশিয়ে দ্যায় তারা, যে, বাবা এত যে লাফাচ্ছ তোমার কিন্তু খবর আছে, জানোনা কি শিবির কি জিনিস? একজন দুজন ক্যাডেটকেও দেখলাম তারা একেবারে হার্ডকোর শিবির - দেশের বিরুদ্ধে, পতাকার বিরুদ্ধে ফেসবুকে পাবলিককে উসকে দিচ্ছে কখনো দেশপ্রেমেরই দোহাই তুলে, কখনো 'বাঁচলে গাজী মরলে শহীদ' আওয়াজ তুলে।

    তো এসকল আগাছার বিরুদ্ধে মানুষের সম্মিলিত যে কণ্ঠ -- এটাই তাদের স্বরূপকে ফের উন্মোচন করে দিয়েছে।আমাদের পতাকা ছিঁড়ে, শহীদ মিনারকে অপমান করে, পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে তার ভেতরের চেহারাটাকে বড় নগ্নভাবে আমাদের সামনে আবার হাজির করেছে।জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা বা সেরকম রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার দিন আসলে শেষ হয়ে গিয়েছে - এটা আমাদের বুঝতে হবে। এবারে মানুষের প্রতিরোধের সময় এসেছে।জামাত-শিবিরের অস্তিস্ত্বই যে আসলে একটা বিরাট ব্লাসফেমি এটা মানুষের বুঝতে হবে। তারা যা ধারণ করে তা আসলে ধর্মের চেয়েও কিছুটা বড় - কারণ তাদের 'ধর্ম' শব্দটির পূর্বে তারা অপরিসীম নিষ্ঠা আর উন্মাদনার মধ্য দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে 'অ' বর্ণটি -- আপনি আমি ধর্ম করতে পারি, না-ধর্ম করতে পারি, কম ধর্ম করতে পারি কিন্তু 'অধর্ম' করতে হলে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে, এদের অনুসরণ করতে হবে।

    জবাব দিন
  2. রাব্বী (৯২-৯৮)
    শত্রু সংখ্যায় দুর্বল। কিন্তু তারা সঙ্ঘবদ্ধ। আমরা সংখ্যায় বহুগুণ। কিন্তু একতাবদ্ধ নই।

    এটাই হলো মোদ্দা কথা। কোনঠাসা থাকার জন্য এরা সংঘবদ্ধ। সাথে পায় ধর্মের লেবাসের জন্য ছাড়। জানোয়ারগুলো ভাল মতোই জানে যে মূলধারার সমর্থন তাদের জন্য নেই। তাই যেটা করে আসছে এরা তাহলো ট্যাকটিকসের ব্যবহার। এবং দীর্ঘ পরিকল্পনা। কিন্তু খেল খতম!

    নতুন শাহবাগ প্রজন্ম এবং ব্লগাররা - এখন জামাতের মাথা ব্যথার কারণ। কারণ এরা জামাতের মেইনস্ট্রিমিংয়ের পরিকল্পনার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।

    জামাত দল, রাজনীতি এবং অঙ্গসংগঠন এখনই নিষিদ্ধ করা দরকার।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।