কাঁড়া আর আকাঁড়া

ছেলেবেলা ম্যাজিকের মতো ছিল। কতোকিছু জানতাম না। কতোকিছুর কার্যকারণ আর কলকব্জা বুঝতাম না। তাই অজানা ব্যাপারগুলোকে ভেলকিবাজি মনে হতো। স্কুল ছুটি হলে এক আইসক্রিমের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতো, দু’টাকা দিলেই কমলা কমলা পলিথিনে মোড়ানো। একপাশের পলিথিন দাঁতে টেনে ছিঁড়ে ফেলতাম, তারপরে মুখের মধ্যে গলে গলে যেতো কমলার স্বাদ। ঠোঁট আর জিব একদম টকটকে কমলা হয়ে উঠতো। সেই আইসক্রিম বানানোর বিদ্যা অজানা ছিলো, খুব আশ্চর্য হতাম, রোজ এতো এতো আইসক্রিম কোথায় বানায়? কে বানায়? যে বানায়, সে কী জানে আমি এই আইসক্রিম কতো পছন্দ করি? জানলে কতোই না ভালো হতো!
.
.
তারপর একদিন বছর পাঁচেকের স্কুল-পেরুনো তাগড়া বড়ো ভাই বললো, এগুলো লম্বা লম্বা বরফ বানিয়ে তার ওপর চিনি আর রঙ মিশিয়ে পলিথিনে ভরে বিক্রি করে আর পানি নেয়া হয় মিউনিসিপ্যালিটির কল থেকে ফ্রি ফ্রি – – – শুনে আইসক্রিমগুলো আমার জিবের ওপর থেকে বাষ্প হয়ে চলে গেলো।
.
.
.
স্কুল বাসে করে বাসায় ফেরার সময় রোজ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে স্পিডব্রেকার পড়তো। বাসটা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে আবার চলতে শুরু করতো। আমি জানালা দিয়ে বাইরে ফুটপাতের পাশে দোকানপাট দেখতাম। স্পিডব্রেকারের কারণে ওই জায়গার দোকানগুলো নড়ে চড়ে উঠতো আমার চোখে। খুব অবাক হতাম, কোনোদিন পাশের কোন দোকান নড়ে না কেন, এই ভেবে। রাস্তার ওপরে স্পিডব্রেকারকে মনে হতো একটা অচল আঁচিল। কখনই সারবে না এমন দুশ্চিহ্ন। মাঝে মাঝে অনেক স্পিডব্রেকার পেলে মনে হতো হ্যাঞ্চব্যাক অফ নট্‌রড্যামের পিঠে চড়েছি। এবড়ো খেবড়ো কুঁজের ভারে নুয়ে থেবড়ে যাওয়া রাস্তার জন্য মায়া হতো।
.
.
একদিন বাস ড্রাইভার মামা বললেন, রাস্তা বানানের সময় কনট্রাকটর ট্যাকা খাইসে, তাই রাস্তাখান বচ্ছর যাইতে না যাইতে এই অবস্তা। ঠিকঠাক বানাইলে মাক্‌খনের লাগান একটা রাস্তা হইতো – – –
আমার ঘোর তখনো ভাঙে নি, তাই ভুল করে জিজ্ঞেস করলাম, স্পিডব্রেকারও কি তাহলে টাকা খাওয়ার কারণে জন্মায়?
.
.
পানের রসে রক্তজবার মতো কুচি কুচি দাঁত ঝিকিয়ে তিনি বললেন, ‘না গো মামা, ইসপিড বের্কার তো বানাই থোয় আমগো লিগা। আমরা য্যান ইসপিড বাড়াইতে না পারি। রাস্তা বানানের পর ইটা দিয়ে উচা কৈরা দেয় – – –
কুজের মতো, আঁচিলের মতো রাস্তার গা থেকে ধীরে ধীরে সব পচে গলে খসে পড়তে থাকে।
.
.
.
এভাবে ক্রমাগত আমার জাদুবিদ্যার ভ্রম ভেঙে যেতে থাকে। আমি এইসব ভাঙনে কষ্ট পাই। নিদারুণ বেদনায় দুঃস্বপ্ন দেখি। তারপর ঘামতে ঘামতে চেঁচিয়ে ঘুম ভেঙে হাতড়ে হাতড়ে জাদুগুলো খুঁজতে থাকি। বিছানার তলে গিয়ে ওগুলো হারিয়ে যায় চুপচাপ। টের পাই না। সদ্য ঘুম ভাঙা কষ্ট নিয়ে ভোর হওয়া দেখি। ভান করতে শুরু করি। ভ্রম ভেঙে গেলেও আমি অনেক কিছু শিখছি। শিখতে শিখতে আমি বেড়ে উঠছি। বুড়ো হয়ে পড়ছি। উঠতে উঠতে আর পড়তে পড়তে আমার ভালো লাগতে থাকে। আমার খারাপ লাগতে থাকে। ভালো লাগা আর খারাপ লাগা নিয়ে আমি একরকম আনকোরা সুখে ডুবে যেতে থাকি।
.
.
*****

৬,০৫৬ বার দেখা হয়েছে

৪২ টি মন্তব্য : “কাঁড়া আর আকাঁড়া”

  1. আহমদ (৮৮-৯৪)

    আরে আন্দালিব, কি খবর? কেমন আছো? আমাদের না আড্ড দেবার কথা ছিল। দেখাই তো হল না এখন পর্যন্ত।

    লেখাটা দারুন হয়েছে। চার্লস ডিকেন্সের গ্রেট এক্সপেক্টেশনস-এর পিপ যেভাবে শিশুকালের বর্ননা দেয়, যেন তারই বাংলা ভার্সন পড়লাম। এককথায় আসাধারন।

    এই লাইনটাতে কেন জানি খুবই মজা পেলাম।

    স্পিডব্রেকারও কি তাহলে টাকা খাওয়ার কারণে জন্মায়?


    চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      হ্যাঁ, ভাইয়া। আড্ডা দেয়ার কথা ছিলো কিন্তু হচ্ছি হবে করে হচ্ছে না। আমি আসলে একটু ঘরকুনো আছি মনে হয়। সিসিবি'র আড্ডায় চলে আসেন একদিন, দেখা আর আড্ডা একসাথে হয়ে যাবে। 🙂

      পিপ - আমার খুব প্রিয় চরিত্র। মনে করিয়ে দিলেন ওর কথা। ছোটবেলায় আমার এক বড়ো বোন ইংরেজি বইটা কিনে দিয়েছিলো। আমার প্রথম পড়া ইংরেজি উপন্যাসগুলোর একটা। তখন এই পিপকেই আমার নিজের মতো মনে হয়েছিলো। বড়ো হতে হতে পিপের মতো হতে পারবো না ভাবছিলাম আর আফসোস করছিলাম। 😛

      জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)
    ছেলেবেলা ম্যাজিকের মতো ছিল। কতোকিছু জানতাম না। কতোকিছুর কার্যকারণ আর কলকব্জা বুঝতাম না। তাই অজানা ব্যাপারগুলোকে ভেলকিবাজি মনে হতো।
    এভাবে ক্রমাগত আমার জাদুবিদ্যার ভ্রম ভেঙে যেতে থাকে। আমি এইসব ভাঙনে কষ্ট পাই। নিদারুণ বেদনায় দুঃস্বপ্ন দেখি।

    অসাধারণ আন্দা'র অসাধারণ লেখা ... :boss:


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
    • এহসান (৮৯-৯৫)

      শেষ প্যারায় এসে মনে হইলো তাইফুরের উচ্চ নম্বরের সিড়ি একটু লাগবে। নাহলে প্রায় পুরাটাই বুঝেছি।
      আন্দালিব এর বিগত লেখাগুলো বেশ সহবোধ্য অনেকটাই তার তোলা ছবিগুলোর মত।
      লেখাটার অনুভূতিগুলো চিন্তা করে খুব ভালো লাগছিলো।

      কারো কাছে সুনীল কিংবা কারো কাছে হুমায়ুন আজাদ মনে হলেও আমার আমিরখানের একটা সিনেমা... তারে জামিন পার এর কিছু দৃশ্যের কথা মনেপড়ে গেলো

      জবাব দিন
  3. আমার ছোটবেলার দুইটা অদ্ভুত চিন্তা শেয়ার করি।
    ১। যখন বাতাস বইতে শুরু করত তখন আমি ভাবতাম গাছ গুলো বুঝি শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে। যেমন আমরা শ্বাস প্রশ্বাস নিতে বাতাস ছাড়ি।
    ২। আকাশে যখন উড়োজাহাজ গুলো উড়ত, সেগুলো দেখতে আমার কাছে মনে হত অনেক ছোট আকৃতির। ভাবতাম যদি টুপ করে একটা আকাশ থেকে পড়ে যেত। তবে, লুকিয়ে খাটের তলায় অন্য খেলনা গুলোর সাথে রেখে দিতাম।

    কি বোকা ছিলাম!!!! কতটুকুই আর চালাক হলাম???

    জবাব দিন
  4. রকিব (০১-০৭)

    অবশেষে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলেন। নিরেট ব্লগর ব্লগর ধরনের পোষ্টগুলো আমি গোগ্রাসে গিলি, কেমন যেন নিজের জোবনের সাথে অজান্তেই রিলেট করে ফেলি। ভালো লাগার মাত্রাটা তাই অনেক বেশি। দারুন লেখা আন্দাদা।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  5. কানিজ ফাতিমা সুমাইয়া (অতিথি)

    লেখাটা পড়ে আমার ছেলেবেলার কিছু কাহিনী মনে পড়ে গেল । যেমন, রং দিয়ে বানানো ওই আইস্ক্রিম গুলো আমরাও খেয়েছি 🙂 আমি ও ছোটবেলায় বিভিন্ন রকম আজাইড়া ব্যাপার নিয়ে খুব মাথা ঘামাতাম 😛
    নাম করন যর্থার্থ হয়েছে :thumbup:

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      হুম, তাহলে মনে হয় নমুনা-বিচার করে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে ছোটরা অনেক আজাইরা বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়। তাদের হয়তো আমাদের বড়োদের মতো বাজে বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামাইতে হয় না - এজন্যই তারা ইজি-চিন্তায় বিজি থাকেন। ভালু ভালু।

      আপনার মন্তব্য পেয়ে খুবই ভালো লাগলো, ভাবী। আমার ব্লগপাতায় স্বাগতম। 🙂

      জবাব দিন
  6. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমার শৈশবের বড় একটা অংশ কেটেছে মাগুরা জেলায়।
    আমরা যখন ৩/৪ এ পড়ি তখন ঢাকা-মাগুরা মহাসড়কে নবগঙ্গা নদীর উপর ব্রীজের কাজ শুরু হল। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রায়ই স্কুলের পর নির্মানকাজ দেখতে যেতাম। নদীর পাশেই আবার ছিল আইস্ক্রিম বানাবার ফ্যাক্টরী, সেখানে অনেক বড় বড় বরফের টুকরাও তৈরি হত। ওখানে আইস্ক্রিম বানাবার প্রক্রিয়া দেখার পর আর খেতাম না...
    যাই হোক, হঠাৎ করে গুজব শুনলাম ব্রীজ বানানো শেষ হলে ওরা নাকি ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মেরে মাথার খুলি পিলারের গোড়ায় পুঁতে দেয়! 🙁 এতে নাকি ব্রীজের স্থায়িত্ব বাড়ে..... :-/ ~x(
    এমনকি মোটামুটি বড় হবার পরও আর ও মুখো হই নি... 😕 :no:

    লেখার সাথে কোন সম্পর্ক নাই, এম্নেই বললাম...
    তোর লেখা পড়ে মনটা কেমন উদাস হইছে... :dreamy:
    ওরে পাগল ম ও ও ও ন... :guitar: উপ্‌স...
    গানও চলে আসছিল প্রায়... ;))


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আন্দালিব (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।