আলো অন্ধকারে যাই…

Between light and darkness

…We all carry these things inside that no one else can see.
They hold us down like anchors, they drown us out at sea…

না হয় আমি তুচ্ছ আর তুমি গুরুত্বপূর্ণ, তা বলে কি আমার হৃদয় নেই? হৃদয় কোথায় থাকে তা তো তুমিও জানো না। যদি বলো আমার হৃদয় নেই, তাহলে তোমারও হৃদয় নেই। তোমার কেবল একটা হৃৎপিণ্ড আছে যা খালি ধুকপুক ধুকপুক করে রক্ত পাম্প করছে; বিরতিহীন। সে জানেও না তোমার হাতের একটু ছোঁয়ার জন্যে আমি কতোটা কাতর।

সেই স্পর্শ হঠাৎ অঘটনে পেয়ে গেলে আমার ভেতরে কী তোলপাড় হয়! মনে হয় টেবিল চেয়ার বাবদ এই বাস্তব চরাচর দুমড়ে মুচড়ে উঠছে কাগজের মতো। কেউ নির্বিকার আমার জগতটা কুড়ানো কাগজের মতো ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে। তুমি যখন না বুঝেই হেসে ফেলো আমাকে দেখে, যখন আমি তোমার হুটহাট তীব্র কথার জবাব দিতে পারি না, থতমত খাবি খেতে থাকি- তখন তোমার ঐ শাদা দাঁতের হাসি দেখা যায়।

তুমি অবিরাম হাসো আর দাঁতের কামড়ে খুঁড়ে ফেলো আমার শরীর। উড়িয়ে দিতে পারো, কিন্তু আমি সত্যিই টের পাই এই বেদনাবোধ। আমি টের পাই তুমি কীভাবে আমার ভেতরে ভাঙচুর করছো আর আমি হাসিমুখে তোমার দিকে চেয়ে আছি। একটা পলকের জন্যেও বুঝতে দিচ্ছি না আমি কতোটা ফুরিয়ে গেছি। তুমি একটু পরে বিরক্ত হয়ে গেলে, আমার চাহনি আর তোমার ভালো লাগছে না। তোমার দমবন্ধ লাগছে তাই তুমি জানালা খুলে দিলে। তিনতলার জানলা হাট করে খুলতেই দমকা বাতাস উড়ে এলো।

নিচের রাস্তায় দুয়েকটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো- যাদের দেখে তুমি স্মিত হাসলে।

তুমি কি জানো তোমার ঐ এক চিলতে স্মিত হাসির কতোটা কাঙাল আমি? আমি একটু পেছন থেকে দেখলাম তোমার চোখের রঙ বদলে যাচ্ছে। মেয়েদের ওড়নার রঙে ঘোলা হয়ে উঠছে মণি। তুমি বারকয়েক পলক ফেলতেই দেখলাম তুমি নেই! উদামখোল জানালা গলে চলে গেছে ওড়নার ভাঁজে। তোমার ঐ খিলখিলে মেয়েগুলোকে ভালো লাগে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে দেখি দুটো মেয়ে হাঁটছে আর তুমি তাদের দিকে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে চলে যাচ্ছো।

আমার সামনে জানালা খোলা। আমার সামনে তুমি নেই।

আমার সামনে ঘোলাটে চোখ নেই। হাসির ছুরি নেই। ঝকঝকে শাদা দাঁতগুলো আমাকে আর কাটছে না। তোমার মাথায় যে এলোমেলো মেঘ ভেসে বেড়াতো, সেটাও এখন অনেক দূরে ঐ আকাশে উড়ে যাচ্ছে। আমার হঠাৎ খুব সাধ হলো, জানো? আমি তো ঐ মেয়েগুলোর ওড়নাকে ভালোবাসি না, কখনো বাসি নাই। আমি খালি তোমার কাঙাল হয়ে গেছি বহুদিন ধরে। আমি খালি তোমাকেই দেখি, তুমি মাঝে মাঝে আমাকে ছুঁয়ে দিলে আমি বারবার মারা যাই। আজ হঠাৎ কী যে হলো? আমার খুব মরতে ইচ্ছা হলো। আমি বারবার তোমার হাতে মরতে চাই না আর। আমার ক্লান্ত লাগে।

আমার তো আর কেউ নাই। আমার মতো আর কেউ নাই। তুমিও আমার নও, আমার মতো নও।

আমি কেবলই আমার মতো, আর আমি জানি এই কথাটা তুমি জানো না। তাই আমি আজকে অনেক ক্লান্ত হয়ে গেলাম। জানালাটা হাট করে খোলা, আমি সেটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। জানালা বললো, “তুমি কেমন আছো ছেলে?” আমি বললাম, “আমি ভালো আছি, জানালামনি।” তোমার মাথার চুলের মতো মেঘগুলো ভাসতে ভাসতে লাফাতে লাফাতে হঠাৎ থমকে গেলো আমার এই মিথ্যা শুনে। তারা ভীষণ অবাক! বললো, “তুমি তো ভালো নেই ছেলে। তুমি বার বার মরে যাচ্ছো। তোমার শরীরে ঐ ছেলেটার দাঁতের দাগ দেখতে পাচ্ছি আমরা।” আমি হঠাৎ হেসে ফেলি, এতো দুখেও ফিক করে বলি, “বোকা মেঘ, তোমরা জানো না শরীরে কেন দাগ পড়ে। তোমাদের শরীরে কেউ দাগ ফেলে না। এই দাগগুলো আমি ভালোবাসি। বুঝলে?” মেঘগুলো মাথা নেড়ে চলে গেলো। আর জানালাটাও চুপ করে কী কী যেন ভাবছিলো। আমি হেসে বললাম, “আমাকে নিয়ে এতো ভেবো না জানালামনি।” ফিসফিস করে বললাম, “আমি ভালো আছি। আমি ভালো আছি।”

আমি খুব তুচ্ছ আর আমার একটা হৃদয় আছে। সেটা কিচ্ছু শেখে নি, সেটা কেবল তোমাকে চায়। তুমি তা জানো না। তুমি জানলেও আমাকে চাইতে না। আমি খুব তুচ্ছ।

===***___***===
১৯.৭.১০

২,০৫২ বার দেখা হয়েছে

৩৩ টি মন্তব্য : “আলো অন্ধকারে যাই…”

  1. তাইফুর (৯২-৯৮)

    হৃদয় আর হৃৎপিণ্ড যে দুইটা আলাদা জিনিস ... শিখলাম
    হুম ...
    পোলা মাইয়ারে "নারী নির্যাতন" করে ...
    তবুও মাইয়া পোলাডারে বেদম ভালবাসে ...
    তাইতো ?? ... নাকি ভুল বুঝলাম 😉

    (এত সুন্দর কইরা ক্যাম্নে লিখস ??)


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
    • তাইফুর (৯২-৯৮)

      আমি = মাইয়া
      তুমি = পোলা ...
      তাই না ?? 😀

      নিচের রাস্তায় দুয়েকটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো- যাদের দেখে তুমি স্মিত হাসলে

      পোলাতো দেখি হাল্কা লুইসও ...


      পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
      মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

      জবাব দিন
      • কামরুল হাসান (৯৪-০০)

        গড়বড় আছে মনে হয় তাইফুর ভাই।

        জানালা বললো, “তুমি কেমন আছো ছেলে?” আমি বললাম, “আমি ভালো আছি, জানালামনি।”

        😀


        ---------------------------------------------------------------------------
        বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
        ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

        জবাব দিন
        • আন্দালিব (৯৬-০২)

          তাইফুর ভাই, আমি তুমি'র জেন্ডার নিয়া ব্যাপক কনফিউশন। হুমম।

          আর লুইস তো হয় যখন বগল'মে এক, গলি'মে এক হয় তবে। বাইরের মেয়ে দেখে স্মিত হাসা 'তুমি' তো ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা 'আমি'র কাছে দায়বদ্ধ না। এমন কি ওয়াকিবহালও না যে 'আমি' তাকে কতোটা চায়। সুতরাং ...

          কামরুল ভাই, চোখের পাওয়ার ৬/৬ আপনের। 🙂

          জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    বারকয়েক পড়লাম। আমি-তুমি কনফিউশন দূর হচ্ছে না।
    মনে হচ্ছে যে কোন একজন হয়তো মানুষ না, অন্য কিছু।

    তবে আমি যেকারণে তোর লেখা পড়ি সেটা হচ্ছে ছন্দময় গদ্য। ভালো লেগেছে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  3. সামীউর (৯৭-০৩)

    বেশ চমতকার উত্তর আধুনিক একটা লেখা, চিন্তাপ্রবাহের প্রভাব,জাদু বাস্তবতা অনেক উত্তর আধুনিক গুণাবলীর উপস্থিতি ছোট গল্পটির মধ্যে পাওয়া যায়। গল্পের সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিটি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের একটি ছোটগল্পকে মনে করিয়ে দেয়। সবমিলিয়ে বেশ চমতকার আঙ্গিক, তবে কিছু কিছু চিত্রকল্পের ব্যবহারে নারীবাদীরা একটু বিতর্ক তৈরী করতে পারে।
    (কালকে সকালেই মাস্টার্স এর পোস্ট মডার্নিজম এর পরীক্ষা, তাই একটি জ্ঞান কপচাইলাম, আসলে গল্পটা পড়তে ভালো লাগসে, এইটাই হইলো আসল কথা)

    জবাব দিন
  4. রেজওয়ান (৯৯-০৫)

    আমি মনে হয় পাইছি...... 😕

    তুমি তো ভালো নেই ছেলে। তুমি বার বার মরে যাচ্ছো। তোমার শরীরে ঐ ছেলেটার দাঁতের দাগ দেখতে পাচ্ছি আমরা

    ২ জনই.......... :no:
    জেনডার কনফিউশন বাদ্দেই ....
    ভাল্লাগছে গল্পটা :clap:

    জবাব দিন
  5. তানভীর (৯৪-০০)
    "তুমি তো ভালো নেই ছেলে। তুমি বার বার মরে যাচ্ছো। তোমার শরীরে ঐ ছেলেটার দাঁতের দাগ দেখতে পাচ্ছি আমরা।”

    শুধু এই জায়গাটায় এসে বুঝতে অসুবিধে হয়েছে, আসলে এখনও এ জায়গাটা বুঝিনি।

    একদম প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল যে, এই অনুভূতি আমি চিনি। তাই লেখার সাথে মিশে যেতে কোন অসুবিধে হয়নি। যথারীতি চমৎকার লিখেছ।

    জবাব দিন
  6. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    ছবিটা খুব ভালো লেগেছে। গল্পের শুরুর শিরোনামে জীবনানণ্দের একটি কবিতার কথা মনে পরে গেলেও তার কোন বোধ অবশ্য পেলাম না লেখায়। বরং আলাদা রকম একটা রহস্যময় মানবীয় অনুভূতি। তবে সবাই গল্পের ভিতরটা অল্প স্বল্প বুঝলেও আমি কিছুই বুঝি নাই। কিন্তু রিফ্লেক্টিভ আর্ট হিসাবেই ভাল্লাগছে।

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      ছবিটা আমারও ভালো লাগছে যখন থেকে দেখেছি। আর শিরোনামটাও জীবনানন্দ থেকে ধারে চালাইলাম। তবে ব্যাপার হলো উনি তো চুয়ান্ন সালেই মারা গেছেন। তারপর থেকে তাঁর কবিতা আর কবিতার লাইন, শব্দবন্ধ নানাভাবে পঠিত আর গৃহীত হচ্ছে। আমি সেরকম চাইলাম এই শব্দগুলোকে নতুন পরিচয় দিতে। বামুনের শখ! 😛

      ইয়ে, দোস্ত, রিফ্লেক্টিভ আর্ট টা জানি কী? একটু বিশদে বল, আমি আসলেই বুঝি নাই। 😕

      জবাব দিন
      • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

        মানে আমি কিছু না বুঝলেই রিফ্লেক্টিভ আর্ট মানে বিমূর্ত কলা ভেবে নেই। অর্থাৎ যে চোখ দিয়ে যেভাবে দেখা যাবে সেই রূপ ধারণ করবে। বারবার পড়লে নতুন দিক থেকে ভাববার সুযোগ থাকবে। তবে পুরাটা মিলায়া নৈর্ব্যক্তিক কিছু প্রকাশ করে না। ঘল্প টা পড়ে এমনই মনে হয়েছে আমার কাছে। এটা অবশ্য আমার বোঝার সীমাবদ্ধতাও হতে পারে ( সেটা হবার সম্ভাবনাই তীব্র।)

        জবাব দিন
        • আন্দালিব (৯৬-০২)

          এখানে ঠিক এরকম ভাবনা থেকেই লিখেছি।

          গল্পে সরাসরি সব ঘটনা আর সংলাপ বলে দেয়াটা আমার কেন জানি 'স্যুট' করে না। মানে, চাইলে লিখতে পারি ওভাবে। কিন্তু কেন জানি লিখতে বসে একটা আড়াল খুঁজি। এটা হয়তো একটা কারণ লেখা দূর্বোধ্য হওয়ার, বা ঠিকমতো বোধে না আসার।

          নিরীক্ষা করতে যাবার ঝুঁকিসহই এই চেষ্টাটা জারি রাখতে চাই। গল্প লেখায় সবসময় একই ধাঁচ থাকলে নিজের কাছেই একঘেঁয়ে লাগে। 🙁

          জবাব দিন
  7. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    তোমার গদ্য আমাকে সবসময় টানে আন্দালিব। একটা ছন্দময় গদ্য। লেখায় কিছুটা পরাবাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা রহস্য রহস্য খেলা তৈরি করে। মনে হয় তুমি শব্দ নিয়ে, বাক্য দিয়ে খেলছো। দারুণ!

    এরকম আরো লেখা আমাদের নিয়মিত উপহার দিয়ে যেও। ভালো থেকো।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)
      মনে হয় তুমি শব্দ নিয়ে, বাক্য দিয়ে খেলছো।

      লাবলু ভাই, আপনার মন্তব্যটা অনেক উৎসাহ দিলো। আমি আসলে সবসময়ে নিজের লেখা নিয়ে একটা খুঁতখুঁতানির মধ্যে থাকি, ঠিক বুঝতে পারি না উদ্ভট চিন্তা কি খালি আমিই করি, অন্যেরা আদৌ বুঝলো নাকি বুঝলো না-- এসব ভাবি। 🙂

      আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা নিবেন, লাবলু ভাই। ভালো থাকবেন। :hatsoff:

      জবাব দিন
  8. দিহান আহসান

    লেখার সাথে মিশে যেতে খুব একটা সময় লাগেনি, চমৎকার করে ফুটিয়ে তুলেছিস ভাইয়া।
    সবাই এত্ত এত্ত ভালো মন্তব্য দিয়েছে, অনেক পরে এসে নতুন করে আর কি লিখবো? পড়েছি অনেক আগেই, মন্তব্য আর দেয়া হয়ে উঠেনি। কিন্তু ভালো লাগার কথাটা জানাতে ইচ্ছে হলো তোকে। 🙂

    আছিস কেমন?

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আমিন (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।