দূরের নগরে দু’জন

“Our life always expresses the result of our dominant thoughts.”

– Søren Kierkegaard

সকালে উঠে মনে হয়েছিলো দিন খারাপ যাবে। নির্জলা দুপুরে ঘুঘু যেমন টেনে একঘেঁয়ে স্বরে ডাকতে থাকে সেভাবে মনের ভেতরে কোন্‌ এক পাখি মৃদু অথচ দীর্ঘ সময় ডেকে চললো – কুউউউ কুউউউ। সেই ডাকের তাল কাটাতে রাহাত খুব জোরে জোরে দাত মাজে। ব্রাশটা নতুন, তাই বেশি জোরে ঘষার কারণে মাড়িতে ব্যথা লাগলে থু করে থুতু ফেলে সে, আর দেখে গোলাপি রঙের থুতুতে বেসিন ভরে উঠছে। নিজে নিজে এমন অযথা রক্তপাতে মনের কুউউউ ডাকটা আবার ভুস করে জেগে ওঠে। আজকের দিনটা খারাপ যাবে… হয়তো। কিংবা আজকের দিনটা হয়তো খারাপ যাবে না।

এই ঘনঘোর ঘুমুটে সকালে বৃষ্টি নামলো। আজ এমন ঘটনায় এখন আর কিছুতেই মন লাগছে না। আজ তাই গল্প বুননের দিন। শুকনো রাস্তার ধুলোর জমিনে যখন প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা খুব দ্রুত আছড়ে পড়ে, যেমন দলবল নিয়ে ধুলোদের সাথে অসম যুদ্ধ শুরু হয় তার, তেমনি সেই যুদ্ধের মুগ্ধ মূক দর্শক হয়ে থাকি আমরা। তারপরে তাদের এই খেলার মাঝেই আমাদের মনে পড়ে আমরা বৃষ্টি বা ধুলো নই, তখন আমরা মৃদুশ্বাস ফেলে মুখ ফিরিয়ে নেই বৃষ্টির ঘোলা শরীর থেকে। তখন আমরা গল্প বুনি। রাহাতও আমাদের মতোন।

রাহাতের আজকে অনেকগুলো কাজ সারতে হবে সারাদিনে। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে সেই লিস্টিটা আরেকবার ঠিক করে নেয়। আর ভাবতে গিয়ে তার বোতাম লাগানোতে ভুল হয়। আয়নায় তাকিয়ে দেখে শার্টটা রাতের মশারি হয়ে গেছে। মাথা ডানে-বামে অল্প ঝাঁকুনি দিয়ে আবার বোতামগুলো খুলতে খুলতে তার মনে পড়ে ছোটবেলায় মা এভাবে বোতাম লাগিয়ে দিতেন। মায়ের কখনো ভুল হতো না। তারপরে মা বাম হাতে তার দু’গাল ধরে চুল আঁচড়ে দিতেন। মায়ের কথা মনে পড়লে রাহাতের হাতদুটো আবার একটু মন্থর হয়। বোতামগুলো যখন একটা একটা করে ঠিক ঠিক ঘাটে বসে যাচ্ছিলো তখন রাহাতের মনে হয় সে মায়ের গায়ের গন্ধ পেলো। তারও খানিক পরে রাহাত যখন রিকশায় করে বাসার গলি থেকে বেরিয়ে বড়ো রাস্তায় পড়লো, তখন দেখা যাবে সে মোবাইলে সারিতার সাথে কথা বলছে।

সারিতার সাথে রাহাতের সম্পর্ক নিয়ে আপনার আপাত-কৌতূহল আর আমার পূর্বানুমান সবই ঠিক। আমি সেখানে কোন ভণিতা করবো না, অভাবনীয় কিছু বলবো না। এই গিজগিজে শহরে যখন আমরা বাসে বা টেম্পোতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে থাকি তখন আমাদের মাঝে বহুবিধ সম্পর্কের শেকড় গজিয়ে যায়। আবার সেই ভ্রমণ শেষে সুতোর মতো শেকড়গুলো কচ্‌ করে কেটে দেই আমরা। আর নির্বিকারভাবে অন্য কারো সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ফুটপাত দিয়ে চলতে থাকি। অনেক সময় ফুটপাতে এপিটাফের মতো সারি সারি হকারদের পসরা মাড়িয়ে দেই, “স্যরি” বলি, বা আমাদের ততোটা বিলাসিতার সুযোগ বা ইচ্ছা থাকে না। তাই আমরা এরকম সম্পর্কগুলো নিয়ে ভাবিত নই। সারিতার সাথে রাহাতের সম্পর্কের স্বরূপও তেমনি – জেনে রাখা ভালো, তবে জরুরি নয়; গ্রাহ্য করা দরকারি, তবে অমোচনীয় নয়।

এই জনমুখর নগরে রাহাতের সাথে সারিতার দেখা হয়ে যায়। খুব প্রাকৃতিক নিয়মে তারা এক অফিসে চাকরি করে। রাহাত যেখানে গত বছর দেড়েক ধরে এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, সেখানে সারিতা জয়েন করে এই তো সেদিনই। গল্পের গরু যেহেতু গাছেই উঠতে চাইছে, তাই সারিতা ছয় মাসের প্রোবেশনে চাকরিটা পায়। সেই প্রোবেশন দেখাশোনার ভার পড়ে রাহাতের হাতে। তাই ছয় মাস পরে যখন চাকরির মেয়াদ ও স্থায়ীত্ব পাকা হয়, রাহাতের নিজেকে হালকা লাগে। হাতে ধরে রাখা সারিতার প্রোবেশনের ভার সরে যাওয়াতে হাত খালি লাগে। বুক খালি লাগে। এমনকি মাথাও খালি খালি লাগতে থাকে। রাহাতের শার্টের বোতাম লাগানোর ভুল বেড়ে যায়। সারিতা কোন ডাক্তার নয়, তবুও তার কাছেই রাহাত জানায়, এই ভারহীনতার অসহায়তা। সারিতার পক্ষ থেকে সেই মুহূর্তে যথেষ্ট সাড়া পাওয়া গেলো। জানা গেলো অফিসের এই ছয় মাসে তারও বস হিসেবে রাহাতকে খুব ভালো লেগেছে। ভারসাম্যহীনতার দোলাচলে সেই বসের আসন থেকে ভালো লাগার আসনে রাহাতের বসাটা ঠিক হবে কি না, সেটা তখনও অস্পষ্ট থাকে।

বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে ঘুমুটে নগরে আলো জেগে ওঠে। ঠিক সেভাবেই রাহাতের ঘুম কেটে যায়। চোখ খুলে দেখতে পায় সারিতার সাথে সেতুবন্ধ ঠিক সেভাবে গড়ে উঠে নাই।

যদি আমরা আরো একটু ভালোভাবে খেয়াল করি, দেখা যায় গরম কফির ধোঁয়ার মতোই উড়ে বেড়াচ্ছে তাদের ভালো লাগা। জমাট বেঁধে ঠিকমতো ‘ভালোবাসা’ নামক আইডিয়া হতে পারছে না। প্রায়ই রাহাত বা সারিতা ফুঁ মেরে ধোঁয়ার রেখাগুলো আরো এলোমেলো করে দিচ্ছে! মধ্যে বেশ কিছুদিন এই ফুৎকারের জোরে ধোঁয়াগুলো হারিয়েই যেতে বসেছিলো। তাই আজকে সারিতাই নিজের উদ্যোগে দেখা করবে বলছিলো, “শুনো, কালকে তুমি কখন ফ্রি আছো?”। রাহাত খুব সহজেই দুপুরের সময়টা ফ্রি করে ফেলে, “দুপুরে শাহবাগে আসো। আমি ওর আশেপাশেই থাকবো”। সারাদিনের সব কাজের মাঝে সারিতার সাথে দেখা হবার ব্যাপারটা তার ভালো লাগে। শাহবাগের পেটের ভেতর মাটির নিচে দোকানটা তার এবং সারিতার ভালো লাগে। ভীড়ভাট্টার শহরে এর চাইতে নিবিড় আর একইসঙ্গে সরগরম জায়গা হয় কম, থাকলেও তাদের সামর্থ্যের বাইরে।

দুপুরে গিয়ে সকালের বৃষ্টি মন খারাপ করে ফেলে। সেই মন খারাপের কাটাকাটিতে গুমোট রোদ ওঠে। রোদের সাথে জবজবে গরম যেন পিচের রাস্তা আর বাস-টেম্পোর শরীর থেকে ঠিকরে বেরুতে থাকে। রাহাত যখন শাহবাগের ফুটপাত দ্রুত হেঁটে পেরিয়ে এসে দোকানটায় ঢুকে পড়লো, তখন তার ঘড়িতে দু’টা বাজে। দোকানটাকে তার কাছে সবুজ কোন গুহার মতো মনে হয়। সরু সিঁড়ির দু’পাশে দেয়ালে সবুজ রঙ করা, সিঁড়ির ওপর কার্পেট দেয়া যেটা বহু পায়ের চাপে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। রাহাত মাথা নিচু করে নেমে আসে, সামনে ঝকঝকে ম্লান সারিতা বসে আছে।

দেখা হলে প্রেমিক প্রেমিকারা কী কী কথা বলে? কেমন করে তাকায়? তারা কি দুই দেশের রাষ্ট্রপতিদের মতো হাসিমুখ আঁকে? শুভেচ্ছা বিনিময় করে প্রথমেই, একে অপরের দেশের নাগরিকদের প্রশস্তি জ্ঞাপন করে। তারপরে নানা বিষয়-আশয় আর চুক্তিতে দস্তখত? এর ফাঁকে কি টুপ করে এক দেশের রাষ্ট্রপতি বলে বসেন, ‘গতকাল রাতে ঘুম হয় নি’, শুনে সমব্যথী হন অপরজন, ‘আহা! বলেন কি! ডায়াজোপাম খান না বুঝি আপনি?’ এরকম আলাপের ফাঁকে ফাঁকে রাষ্ট্রীয় আদান-প্রদান ঘটতে থাকে। রাহাতের সাথে সারিতার আলাপের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় এরকমই কিছু টুকরো টুকরো কথা, মাথা ব্যথার ট্যাবলেট বা বেখেয়াল শাদা ব্রায়ের স্ট্র্যাপ, প্লাস্টিকের মেন্যুতে হলুদ ঝোল এবং টেবিলের কোনায় বেরিয়ে থাকা লোহা। ওয়েটার এসে একটু পরে পরে জিজ্ঞেস করছে, বিরক্ত করছে, ‘আর কিছু লাগবে, স্যার?’। রাহাতের এইসব কোলাহল ভালো লাগে না। সারিতা অস্থির হয়।

এরকম যন্ত্রণার শহরের গলি ঘুপচি পেটের ভেতরে বসে বসে রাহাত ও সারিতার দিকে তাকিয়ে আমাদের ভালো লাগে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে যখন মুচকি হাসতো, সেই খোপ খোপ পোয়াতি অফিসের ভেতর, তখন আমাদের ঠোঁটে মুচকি হাসি আঠালো লেগে থাকতো। মাঝে মাঝে সারিতা খুব সুন্দর করে চোখে কাজল দিতো, আর কমলা বা সবুজ কামিজ পরে আসতো। রাহাত অনেক টাকা জমিয়ে একটা ফরাসি পারফিউম কিনেছিলো, মাঝে মাঝে সৌখিনতা ভালো লাগে, বিশেষ করে যেদিন ব্রিফিং থাকতো সেদিনকে সে ফিটফাট হয়ে যেত খুব। আজকে দু’জনেরই ছুটি। অফিস থেকে। নিজেদের থেকেও হয়তো। আমরা অনেক জ্যাম ও জট ছাড়িয়ে দেখতে পাই সেই দোকানে একই টেবিলের দুই পারে বসে রাহাত ও সারিতার মাঝে দুয়েকটা মহাদেশ ঢুকে পড়ছে। গল গল করে সুনামি কি লাইলা’র বেনে জল ঢুকে পড়ছে। সেই জলে পেপসির আধ-খাওয়া বোতল এবং প্লাস্টিকের মেন্যু ভাসছে। আর অনেক দূরে, অনেক ক্ষীণস্বরে একটা ঘুঘু ডাকছে। আমরা ঠিক মতো শুনতেও পাই না। ওদের দিকে সব মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকি আমরা। আর শাহবাগের সেই দোকানের ভেতর নিরন্তর একটা ঘুঘু ডেকেই চলে। ডেকেই চলে।

**** ****
– অনীক আন্দালিব
৭.৭.১০

১,৮৯০ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “দূরের নগরে দু’জন”

  1. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    তোর গল্প গুলার মধ্যে আমার অপছন্দনীয় একটা জিনিস আছে , কেমন করে গল্পগুলা যেন নাগরিক কথকতা হয়ে যায়।
    আমার নিছক গল্পই ভাল লাগে। তবে তোর ভাষার গঠন আর বাক্যের সৌন্দর্যের কথা না বললেই নয়।

    জবাব দিন
  2. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    তৃতীয় প্যারার শেষ লাইন আর শেষের আগের প্যারার শেষ লাইন, এই দুটো লাইন খাপছাড়া লেগেছে।

    বলার ভংগী বরাবরের মতই চমৎকার। ভালো লাগলো ধুসর ভাবটাও।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ইফতেখার (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।