বাইরে যদি খুব তীব্র আলো থাকে, তাহলে ঘরের ভেতর থেকেও সেই আঁচ টের পাওয়া যায়। জানালাটায় পর্দা দেয়া, তারপরেও সূর্যের আলোর তেজ পর্দার ঘেরাটোপ পেরিয়ে চলে আসে। আমি এরকম দিনে খুব ঘরকাতুরে হয়ে পড়ি, এ’ঘর-ওঘর করি। তারপরেও নিতান্ত দরকার না পড়লে বাইরে বের হই না। এখন কোনো কোনো দিন ছুটি থাকে, কোনো কোনো দিন সারাদিন কাজ। যেদিন কাজে থাকি, নিঃশ্বাস ফেলার সময়ও পাই না, সেসব দিনে আমি ভালো থাকি। আর নিজের ঘরে স্বেচ্ছাবন্দিত্বের দিনে আমার কেবলই তাদের কথা মনে পড়ে।
ঝিম ঝিম দুপুর গড়িয়ে গেলে আমার ঘুম ভাঙত। একজন তার অনেক আগেই ঘুম ভেঙে উঠে চলে গেছে। কামলাগিরি করে বহুজাতিকে, সেখানে দশটা পাঁচটা বলে আদতে আটটা-আটটা খাটিয়ে নেয়। খাটতে খাটতে তার খাটিয়ায় ওঠার দশা। ভোরে বের হয়ে যায়, বাস ঠেলে অফিসে ঢোকে। বের হতে হতে নিশুতি। আবার ফিরে আসতে আসতে তার খাওয়ার ইচ্ছাটুকুও থাকে না। আমরা বাকি দু’জন যখন কোন মুভি’টা দেখা দরকার, বা আজকে আসলে ইন্টারনেটে নতুন সাইটটার ভেতরে ঘোরাঘুরি করার ফন্দি কষি, সে তখন ভোসভোসিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমরা তাকে বিরক্ত করি না, শান্তিতে ঘুমাতে দেই। তারপরে একটু নেট ঘেঁটে বলি, “নাহ, এই ফেসবুক নামের সাইটটা বেশ মজাদার। এতে ঘোরাঘুরি করতেও মজা লাগছে।”
একটু পরে আমরা নাটক দেখতে বসি। ইংরেজি নাটক, যা কিনা মার্কিন মুলুকে সপ্তাহে সপ্তাহে একদিন করে দেখায়, আর আমরা গরীব দেশে সেটা একবছর পরে একবারে সারাবছরের সব পর্ব দেখি। তাতে ক্ষতি নেই, আমাদের মনে হতে থাকে এটা একটা অন্তহীন মুভি। পর্বে পর্বে চমক। আমরা তর্ক করি কেন সুপারম্যান একটা ‘গুড-ফর-নাথিং’ লানা ল্যাঙের পিছনে ঘুরছে? কেন সে তার পাশেই ক্লোয়ির দিকে একবারও তাকায় না!
তারপর রাত বাড়লে আমাদের ক্ষুধা পায়। আমরা পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে বের হই আর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছাউনির নিচে তাওয়ার কাছে গিয়ে বসি। এখানে তেল তেল পরোটা আর আধাকাচা ডিমভাজি পাওয়া যায়। আমরা সেই আগুনেগরম তেল-পরোটা-ডিম-ভাজি দ্রুত মুখে চালান করে দেই। দেরি করলেই আঙুল নয়তো জিব পুড়ে যেতে পারে। একটু খেয়ে আমার সাথে যে ছেলেটা আছে, সে সিগারেট ধরায়। আমি সিগারেট খাই না। খালি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমার চারপাশের প্রিয় মানুষেরা সিগারেট কেন খায়, এটা নিয়ে ভাবতে বসি। আমরা দেখি ফাঁকা রাস্তা দিয়ে পরাবাস্তব দৃশ্যের মতোন মহিষের পাল যাচ্ছে। কালো রাস্তার পিঠে কালো কালো মহিষগুলোকে আমাদের অন্যজগতের মনে হয়, কেমন নিঃশব্দ চলাচল তাদের। যেন চোখ বেঁধে নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছে তারা! একবারও ভাবছে না যে কালকেই হোটেলে হোটেলে তাদের মাংস কালাভুনা হয়ে আমাদেরই পেটে চলে যাবে। মহিষের পালের রাখালটাকে আমার ভালো লাগে না, তার চেহারা অস্পষ্ট।
ছেলেটার সিগারেট খাওয়া শেষ হয়। এখন চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠিয়ে আমরা ট্রাফিক সিগন্যালে বসে আছি। জনহীন রাস্তায় সবুজ-লাল বাতি একা একাই জ্বলে! আমরা ভাবি, আবোল তাবোল।
তারপর অনেক দিন পার হয়, এভাবেই। তারপরে আমি ভুলে যাই আমি এরকম দিন কাটিয়েছি। সেই ছেলেটাও ভুলে যায় হয়তো। হয়তো আমি ভুলি নাই পুরাপুরি। ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটা চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদেশ চলে যায়। সিগারেট খাওয়া ছেলেটা বিয়ে করে। বউসমেত বিদেশ যাওয়ার সব ঠিকঠাক হয়। তারপরে আমাদের মাঝে পনের মিনিটের রাস্তা রেখে আমরা চাকরি করতে থাকি। ঘানি টানতে থাকি মহিষগুলোর মতোন। তারপরে আমিও হয়তো অনিশ্চিত কোথাও চলে যাই! কোথায় যাই?
তারপর আর কোন গল্প থাকে না। সেই ফেসবুক নামক চমৎকার সাইটে কয়েকশ বছর আগে তুলে রাখা গোপন অ্যালবামটা ঐ সিগারেটখোর ছেলেটা কোনো এক একলা রাতে খুলে বসে। তারপর সেখানে ছবিতে বসে থাকা মুখগুলো দেখে নিজেকে চেনার চেষ্টা করে। একটু পরে অন্য দু’জন একটা করে নোটিফিকেশন পায়। সবকিছুর মাঝে থেকেও বাকি দুইজনে চুপচাপ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
*****
২৫শে এপ্রিল, দুই হাজার দশ
পরথম।যাই এইবার পড়ি।
ঘুম নাই তোর? 😐
তোরও কি ঘুম নাই? 😛
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
হেহে, ধরে ফেলছেন তাইলে ব্যাপারটা! 😉
আমিও জেগে আছি... এরকম একটা গল্পের জন্য জেগে থাকা যায়...
রেশাদ ভাই, অনেকদিন বাদে লিখলাম... সেইরকম রাত জাগা আবারও ফিরে এলো, আর আপনিও!
ভালো থাইকেন, ভাই।
চমৎকার মন খারাপ করে দেয়া একটা স্মৃতিকথা।
আগে অনুভুতিগুলো অনেক তীব্র ছিল, এখন সময়-চাকুরী সব মিলিয়ে ওরা কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেছে! নিজের ভিতরের পরিবর্তন টের পাই কিন্তু ফিরে যেতে পারি না সেই সময়ে! 🙁
কথা ঠিক। আমাদের অবস্থা আসলে ইলিশ মাছের মতোন। জন্মাইছে সাগরে কিন্তু ডিম পাড়ার জন্যে নদীতে আসতে হইছে। এখন সাগরের ঘ্রাণের জন্যেও পেট পুড়ে! 🙁
ইশ! 🙁
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
কি হলো? 🙁
ঘোর লাগা অনুভুতি হচ্ছে। ভালো লেগেছে তোর গল্পোটা B-)
ঘোরের মধ্যেই লেখা। ঘরের মধ্যে বসে। গল্পের সাথে জড়ানো মানুষগুলা এই ঘোরের জন্যে দায়ী। 🙁
:boss:
🙂
:boss:
পড়ার জন্যে ধন্যবাদ, ফরিদ ভাই :hatsoff:
🙁 🙁 🙁
x-( x-( x-(
রাগিস কেন? সবাইরেই তো চিনিস। আমি, তারা, তুই- সব একই গোয়ালের...
মনের দুঃখে রাগ করি । আহারে...
:boss: :boss:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
:hatsoff: :hatsoff:
স্মৃতিকথা........ :dreamy: ...... 🙁
হুমম। মনে জমে, আর সেখান থেকে তুলে তুলে রাখি। পুরাই সেচ প্রকল্প। B-)
:)) :))
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
অনেকদিন পর লগ ইন হলাম এই গল্পতে কমেন্ট করতে। ব্যাক্তিগত কিছু কিংবা অনেকটা এই গল্পের মত কোনো গল্পের ঘোরে মনটা বিষণ্ণ কিংবা বিক্ষিপ্ত কয়েকদিন ধরে। জোয়ানার পাশে হেঁটে যাওয়া মহিষগুলার মত অথবা তাদের চেয়ে একটু আলাদা কোন এক মোষ শাবককে দেখতে পাই কল্পনার চোখে। পাহাড়ের পাশে চিরচেনা তৃণভূমে বিচরণ করে সে দল হারা হয়ে দলের লোকদের যাওয়ার পথকে অনুসরণ করে দূরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘোর লাগা মায়াবতী চাঁদের নিচে সেই মোষশাবক তার কোন এক সঙ্গিনীকে জড়িয়ে স্বপ্নহীন চোখে নতুন করে সাদাকালো স্বপ্ন বুনতে চায়।
গল্প কেমন হইছে না হইছে বোঝার চেষ্টায় গেলাম না আমার অনুভূতির সাথে টিউনড বলেই পাঁচ তারা দাগিয়ে গেলাম।
তোর কথাগুলো অনেক স্মৃতিকে জাগিয়ে দিলো। ভাল লাগলো দোস্ত!
:clap: :boss:
"Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
- A Concerto Is a Conversation
থেংকু আশহাব। 🙂 :hatsoff:
:just: পড়লাম। থ মেরে গেলাম। কমেন্ট করতে পারছি না। কি লিখবো? কি বলব? ভাষাটা যেন সাপোর্ট দিচ্ছে না। অসাধারণ :thumbup: একটা লেখা পড়লে কি এমনই হয়?
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
বস, মাঝে মাঝে কিছু না বললেও হয়তো বুঝে নেয়া যায়...
আপনার মন্তব্যটা সেরকম। অনেক ভালো লাগলো! 🙂
খুব ভালো লাগলো। লেখাটাতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা নস্টালজিয়ার সুর ছিল যা মন ছুঁয়ে যায়।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
অনেক অনেক থ্যাংকস আপু। 🙂
লেখাটা আমার এই কয়েকদিনে খুব আপন হয়ে গেছে। অনেক বেশিই আপন। সেটা কারো ভালো লাগতেছে জানলে কেমন অনুভূতি হয়, সেটা আমিই প্রকাশ করতে পারবো না!
আহ সেই সব দিনগুলি ...
🙁
I wish I could show my facial expression right in here.... তাহলে আর 'সেইরকম' শব্দটা ব্যবহার করা লাগত না কারণ কখনো কখনো অভিব্যাক্তি ভাষার চেয়েও জোরালো হয়, expressive হয়।
তোমার প্রোফাইলের ছবিখানা দেখেই তো আমার টাশকি খেতে হলো! :clap:
নেটের ভেতর দিয়ে ওয়েবক্যামের মতোন চেহারা দেখানোর একটা বাক্স থাকলে ভালোই হতো!
যেদিন কাজে থাকি, নিঃশ্বাস ফেলার সময়ও পাই না, সেসব দিনে আমি ভালো থাকি।...........
একদম সত্যি কথা বলছো....খুবই ভালো লাগলো পড়ে
থেংকু রশিদ ভাই। আপনিও তাহলে সেই ব্যস্ত দিনগুলোতে ভালো থাকেন, আর বাকি দিনে ... 🙂
:hatsoff: