নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকঃ পর্ব ৫ (শেষ পর্ব)

পূর্ব প্রকাশের পর…

রাইন,

হ্যাঁ, ঘুমান। (বাবা-মায়ের সাথে নাশতা খাওয়ার প্ল্যান বাতিল?)

আপনাকে সারা রাত জাগিয়ে রাখলাম আজকে। অবশ্য এজন্য আমার একটুও দুঃখ লাগছে না… অপরাধবোধও না! কারণ আমি জানি আমার কাছে লিখতে আপনার ভালোই লাগলো, আমারও যেমন। না? 🙂

লর্ড অফ দ্যা রিংস আমারও খুব প্রিয় একটা মুভি। আমরা প্রত্যেকটা হলে গিয়ে দেখসি। কয়েকটা দৃশ্য আছে এতো সুন্দর। ঐ দৃশ্যটা মনে আছে আপনার? একটা বনের মধ্যে দিয়ে এল্‌ভ্‌সদের একটা দল হেঁটে যাচ্ছে। সবাই খুব সুন্দর… পারিপার্শ্বিক সুন্দর… সবাই নীরব… ঐটা দেখলেই আমার স্বপ্নদৃশ্য মনে হয়।

আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র হলো… স্যাম। আর খুব সুন্দর একটা দৃশ্য একদম শেষ অংশতে… যখন ফ্রোডো ফিরেছে জয়ী হয়ে আর সবাই ওকে ঘিরে আছে, পরদিন সকালে আস্তে চোখ খুললো চারপাশে অনেক মুখ… সবাই খুশি, সবাই গর্বিত… সবার এক্সপ্রেশনে মায়া… ভালোবাসা… ফ্রোডো সারাঘর খুঁজতে থাকে… আর হঠাৎ করে স্যামের মুখ উঁকি দেয় দরজার আড়াল থেকে। আর খুব স্মিত হাসে। আর কেউ দেখে না ওকে, শুধু ফ্রোডো ছাড়া… কী সুন্দর না?

আমি যতোবার ঐ অংশটা দেখি আমার কান্না চলে আসে… আমি অবশ্য সবসময় মুভি দেখলে অনেক কান্নাকাটি করি!

আমার কী মনে হয় জানেন? যতোই সুন্দর হোক দেশ… যে কোনো কিছু… বেহেস্তের মতোন হোক, তবু মানুষের মধ্যে তার বড়ো হওয়ার জায়গাটার প্রতি আলাদা একটা টান থাকে… আর কোনোকিছুই “হোম” না… তাই… আপনার বিদেশী আত্মীয়রা যেমনই হোক, আপনি কখনোই ঐ রকম ফীল করবেন না আমি জানি। যে দেশেই যান… শেষমেশ ঐ ধূলা, কাদা, ভীড়, ট্রাফিক এই গুলাই মিস করবেন। আমি মাঝে মাঝে আমার বন্ধুদের ফোন করি, ওরা যখন রাস্তায় থাকে। চারপাশের এতো শব্দ! গাড়ির হর্ন… মানুষের কথা! আমার অনেক অনেক ভালো লাগে… মনে হয় আমিও ঢাকার রাস্তায়। কিছু ভালো লাগা থাকে, যা ভিতরের… বাইরের আপাতত সৌন্দর্য বা আগলিনেসের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নাই। কি যেন একটা কবিতার লাইন আছে না? “নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা!” … অথবা নজরুল গীতি মনে পড়ছে এখন… “যত ফুল ততো ভুল কণ্টক জাগে, মাটির পৃথিবীটাই এতো ভালো লাগে… স্বর্গের প্রেমে নাই বিরহ অনল, সুন্দরও আঁখি আছে, নাই আঁখি জল…”

চোখের পানি বলেন, অনুভূতি অথবা স্মৃতি… এই গুলা মিসিং লিঙ্ক। যখন আমি ঢাকার কথা ভাবি, তখন একটা মায়ার প্রলেপ থাকে ভাবনার ওপরে… তাই কোনকিছু খারাপ লাগে না… সব ভাল…

আপনার আম্মার কথা শুনে আমার অনেক ভালো লাগছিলো… সব বইলেন… একদম মহাকাব্য লিখলেও আমি খুশি!

আপনার জীবন-যাপন এখন কেমন? আমার তো এম্নিতেই আপনার সাথে কথা বলে যে ধারণা হয়, তাতে মনে হয় অনেক অগোছালো… বাবা মা আসলেই আজব জিনিশ। মাঝে মাঝে ওরা কতো কিছু কল্পনা করে কষ্ট পায়, অপরাধবোধে ভোগে, অথচ আমাদের হয়তো ঐসবকিছু মনেই থাকে না। আমরা তিন বোন, আমি সবচেয়ে বড়ো এবং আমার বাবা মায়ের মতে, সবচেয়ে বোকা… ওদের বেশিরভাগ চিন্তা আমাকে নিয়ে থাকে, কারণ আমি নাকি অনেক ভালনারেবল্‌ , একা একা কিছুই পারি না! অথচ ওদের ধারণার চেয়ে আমি অনেকই অন্যরকম। শেষ বার যখন ওরা আমার এখানে বেড়াতে আসছিলো, তখন একবার আব্বা নোটিস করেছে যে আমি রাবিশ বিন নিয়ে রেখে আসছি ড্রাইভ ওয়েতে, যেখান থেকে উইকলি কালেক্ট করে… ঐটা দেখেই আব্বা একদম ইমপ্রেস্‌ড! ‘আমার মেয়েটা কী রেসপন্সিব্‌ল হইসে, কত্তো কাজ করে!’…

আমার এই রকম ভালো লাগে… আর আপনার মতোনই হঠাৎ করে কান্না চলে আসে, একটা পৃথিবী থাকবে, যেখানে একদিন আমার বাবা মা থাকবে না, অথচ আমি থাকবো, আমি এখনও এমন ভাবতে পারি না… বা বিশ্বাস করতে… আস্তে আস্তে মানুষের যাওয়ার জায়গা কমতে থাকে, না?

আপনি এতোক্ষণে নিশ্চয়ই খুব ঘুমাচ্ছেন! আমি তো মাঝখানে লাঞ্চ-ব্রেক নিয়ে আবার আসলাম। এই চিঠির উত্তর যদি দেন, তাহলে আমার অন্য একাউন্টেও cc করে দিয়েন, নয়তো সোমবারের আগে দেখা হবে না।

অনেক ভালো থাকেন আর সুখে নিদ্রা যান!

নিয়ন্তি

-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-

.
.
.

নিয়ন্তি,

আজকে সারাদিন খুব ব্যস্ত গেলো। খুবই ব্যস্ত। আমার ভিসা হয়ে গেছে। বিদেশ চলে যাচ্ছি। আমার যাওয়ার পুরোপুরি ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু অবস্থা এমন হয়েছে! আমার চারপাশের সবকিছু ভেঙে পড়ছে। আমি ঠিক জানিও না আমি এখন এখানে কী করছি, কেনো করছি। নিঃশ্বাস নেয়াটাই যদি জীবন হয় তাহলে সেটাই এখন কাটছে।

আপনার সেদিনের ভোরে পাওয়া মেইলটা সারা সকাল ঘুমিয়ে দেখতে দেখতে দুপুর। পরের কিছুদিন ভর্তির দৌড়ে কাটলো। তারপরে আমার ভর্তিটা হয়ে গেলো। এর পরে ভিসাটাও। মনে হলো আজকে আপনাকে একটা মেইল করা যায়।

আপনার অফিসের মেইলে এর মাঝে দুয়েকটা মেইল করেছি। আপনি কি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন? মেইলার-ডিমোন আমাকে অশুভ শয়তানের মতোই বড়ো বড়ো নোটিশ পাঠিয়েছে যে আপনার ঠিকানা ইনভ্যালিড। ভেবে দেখলাম চাকরি না ছাড়লে মেইল একাউন্ট ডিলিট করার কথা না।

আমাকে জানাতে পারতেন। তিন মাস কেটে গেলো, জানাননি। যাক, জানাননি যখন…

এই মেইলটা একই নামের জিমেইলে পাঠাচ্ছি। শিওর না যে আপনি পাবেন। শিওর না যে আপনি পড়বেন আর জবাব দিবেন। সেই রাতের সবগুলো মেইল আমি মাঝে মাঝে পড়ি। পুর্নেন্দু পত্রী কেন কথোপকথন লিখলেন?

আমি গতকাল ফুলার রোডে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে এখন শীত, রোদ পড়ে আসলে হাড়ে কাঁপন লাগে। আমি সেই বড়ো গাছটার নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। সেই মেয়েটাকে কল্পনা করার চেষ্টা করলাম, যে অনেকদিন আগে এখান দিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে হেঁটে গিয়েছিলো। মেয়েটা এখানে নাই। তার স্মৃতিটা আমার কাছে দিয়ে গেছে।

এই মেইলটা যদি না পান, তাহলে বেশ অদ্ভুত ব্যাপার হবে, মেইলার-ডিমোন বেটা আমাকে দুইবার করে ওয়ার্নিং দিবে যে আমি বোকার মতো মাথা খুঁড়ে মরছি। ভার্চুয়ালি আমি আরো একবার সেকেলে প্রমাণিত হবো।

পুরোপুরি হইনি যদিও, কারণ আমি বিদেশ চলে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি, কোথায় থিতু হবো এগুলো বলবো না এখন। যোগাযোগের সেতু তৈরি হলে… হয়তো… হয়তো না।

মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের মেইল করার আয়ু আমরা এক রাতের সব মেইলেই শেষ করে ফেলেছি। সেজন্যেই আর কথা হলো না, সেজন্যেই আর যোগাযোগ হলো না। মাঝে মাঝে আমার কাছে সবকিছু অবাস্তব মনে হয়, স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়…

মেইল পেলে শুভেচ্ছা নিবেন। আর না পেলে বাতাসে সেই আন্তরিক শুভেচ্ছাটা পাঠিয়ে দিলাম। মেসেজ ইন আ বটল!

রাইন

-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-
.
.
.

Mail Delivery Subsystem

To: rayeen.****@gmail.com

This is an automatically generated Delivery Status Notification

Delivery to the following recipient failed permanently:

niyontee.****@gmail.com

Technical details of permanent failure:
DNS Error: Domain name not found

– Show quoted text –

***

(সমাপ্ত)

৩,০৮১ বার দেখা হয়েছে

৪৮ টি মন্তব্য : “নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকঃ পর্ব ৫ (শেষ পর্ব)”

    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      হুম, হয়তো শেষটা ঠিক মতো হয়নি। আরো দশটা লেখার মতো টানতে পারছিলাম না। আমার এমন সিরিজ লেখার অভিজ্ঞতাও নাই তেমন। আমি পুরোটা পড়ে দেখলাম, যে এটাকে এক রাতের মেইল-অভিজ্ঞতা হিসেবে চালানো যায় কিন্তু!

      হয়তো পরে আরো কোনো এক সময়ে রাইন ও নিয়ন্তি আবার নতুন কাহিনী নিয়ে ফিরে আসবে। এখনও সেই ভবিষ্যত আমার জানা নেই আদনান ভাই।

      জবাব দিন
      • আদনান (১৯৯৪-২০০০)

        নারে আন্দা ফিনিশিং ঠিক আছে । লেখাটা ভাল লেগে গেছিল, ভাল কিছু শেষ হয়ে গেলে একটা বিষন্নতা কাজ করে । তবে একটু তাড়াহুড়ো করছিস । তবে জীবনটা কিছুটা এরকমই, অনেক কিছুই হুট করে শেষ হয় । লেখাটা তোর ভাল লেখাগুলোর অন্যতম ।

        জবাব দিন
  1. জাহিদ (১৯৯৯-২০০৫)

    লেখক রে আইপি শুদ্ধা ব্যান করা যায় না?? হঠাৎ করেই শেষ করে দিলেন। প্রথম ইয়ের =(( মত :just: মনের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠলো।

    Delivery to the following recipient failed permanently:

    niyontee.****@gmail.com

    =(( =(( =(( =((

    জবাব দিন
  2. তানভীর (৯৪-০০)

    আহা রে! 🙁 🙁

    মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল! কল্পনা করতে ভালো লাগে নিয়ন্তি যে দেশে থাকে, রাইনও সেখানে যাচ্ছে। কোন একদিন পথে কিংবা সুপারমার্কেটে দেখা হয়ে যায় তাদের.....

    চমৎকার একটা সিরিজের জন্য অনেক ধন্যবাদ আন্দালিব। 🙂

    জবাব দিন
  3. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    সব গুলা একসাথে পড়লাম। তাড়াতাড়ি দুজনের বর্তমান অবস্থা জানার জন্য লাফ দিয়ে দিয়ে শেষ পর্বে আইসা দেখি তোর ব্যাঞ্চাইতে হইল। ভাল লাগছে।
    মাঝে মাঝে খুব একা একা লাগে এরকম প্রতি মেইলের উত্তর দিবে এরকম কেউ যদি থাকত।
    ভাল আছিস দোস্ত? বাইরে যাবি নাকি?

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)
      মাঝে মাঝে খুব একা একা লাগে এরকম প্রতি মেইলের উত্তর দিবে এরকম কেউ যদি থাকত।

      হুমম, এরকম ঘটনাগুলো আবার মানুষের জীবনেই ঘটে। তবে তোর এই আকুতিটা আমাদের সবার মাঝেই আছে- অন্যের কাছে মূল্য আর মনোযোগের কাঙাল আমরা সবাই-ই!

      জবাব দিন
  4. সামি হক (৯০-৯৬)

    আন্দালিব মনটা এরকম খারাপ করে দিলা ক্যান? আজকে ট্রেনে বাসায় ফেরার সময় সারাক্ষণ লেখাটা মাথায় ঘুরছে আর মন খারাপটা বেড়েছে। তবে এইটাও ঠিক যে শেষটা খুব সুন্দর হয়েছে।

    জবাব দিন
  5. রকিব (০১-০৭)

    সিরিজটা একটু বেশিই ভালো লাগছিলো; দিলেন তো মাঝপথে ব্রেক কষে। তবে শেষটা অদ্ভুত সুন্দর লেগেছে। এক রাতের কথোপকথনটুকু যেন- হাওয়ায় ভেসে যায়, ফেলে মোহময় এক আবেশ।
    আন্দালিব ভাই, আপনি বিরিক্ষ জাতির গর্ব। :boss:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  6. টুম্পা (অতিথি)

    আহা,এবার দেরি করে ফেললাম পড়তে!
    অসাধারণ সমাপ্তি । এরকম গল্প এভাবেই শেষ হতে হয়। শেষ হয়েও হয়তো অদ্ভূত এক অনূভুতি রেখে যায়! অনেকদিন পরেও হয়তো ভিন দেশে কোন এক ঝুম বৃষ্টির দিনে একলা হেঁটে যাওয়া কাউকে দেখে মনে হবে, নিয়ন্তি নয় তো??

    জবাব দিন
  7. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    বিরাট মেজাজ খারাপ x-(
    এইটা একটা ফিনিসিং হইলো 😡

    (খুব বিষন্ন লাগছে ত', তাই............আসলে খুব ভালো লেগেছে)।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  8. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    ভালো লেগেছে,

    শেষটা সুন্দর করেছো, মাঝের এক বা দুটো ভালো লাগেনি, ঝুলে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল, তবে শেষটা একদম পুষিয়ে দিয়েছে।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আন্দালিব (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।