নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকঃ পর্ব ২

পূর্ব প্রকাশের পর…

রাইন!

ইশ! কতো কিছু মনে করায় দিচ্ছেন!

আরেকটা গাছ ছিলো। ফুলার রোডের ঐ পাড়া। ভিসির বাড়ি আর ইউনিভার্সিটির মাঝখানে একটা আইল্যান্ড ছিলো, তিনকোনা। সেই আইল্যান্ডের মাঝখানে… মাঝখানেই তো।
একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। আমি ল্যাবরেটরি স্কুলের যেতাম আর উইক-এন্ডে ঐ খানেই ছায়ানট, নাচ শিখতাম। কখন ফোটে কৃষ্ণচূড়া? গ্রীষ্মকালে?
পুরা রাস্তায় পাঁপড়ি ছড়িয়ে থাকতো আর আমি মাঝে মাঝে তুলতাম। ডায়েরিতে রাখতাম।

আমার একটা বান্ধবী ছিলো। নাম হলো দিয়া। ও পুরনো উদয়ন স্কুল যেখানে ছিলো, তার পাশের পাড়ায় থাকতো। একদিন এমন বৃষ্টি আসলো, ওর কোনো ছাতা নাই আর আমার কাছে একটা ছাতা। আমরা দুই জন এক ছাতার তলায় আসলাম দৌড়াতে দৌড়াতে। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজলাম ঠিকই। পরে, আমার পাড়ার গেইট পর্যন্ত এসে ওকে দিয়ে দিলাম ছাতাটা। আর আমি আরো ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরলাম। বৃষ্টিটা অনেক ভালো ছিলো। অনেক!

চশমা নেয়ার আমারও শখ ছিলো জানেন? আমাদের বাসায় একটা ফ্যামিলি আসলো বেড়াতে। উনাদের তিন ছেলেমেয়ে। সবগুলার চশমা পড়তো! আমার শখ অবশ্য মিটেছে। এখন ড্রাইভ করতে হলে চশমা পড়তে হয়। কিন্তু এখন আর ভালো লাগে না। স্পেশালি বৃষ্টির মধ্যে মহা যন্ত্রণা। তখন মনে হয় চশমায় যদি ওয়াইপার থাকতো, গাড়ির মতোন!

কী দারুণ বলেন? যেই গাছটা আমি দেখতাম ঐ গাছটা আপনিও দেখেছেন। এটা একটা যোগাযোগ। আপনার সাথে আমার, না? এই রকম আমার ভালো লাগে। মনে হয় যে আপনাকে আরো কত্তো আগে থেকেই চিনি… যখন চিনতাম না…

সুন্দর করে বলসেন, অধিকারের কথা। অধিকারবোধ আর অধিকার এক জিনিস না, তাই না? বোধহয় একটা অনুরণনের মতোন… মাঝে মাঝে অধিকার জন্মাবার আগে থেকেই অনুভূতিটা থাকে… আবার শেষ হওয়ার পরও বাজতে থাকে।

আপনার বাসায় ফেরার কথা শুনে আমার অনেক আগে লেখা একটা কবিতার কথা মনে পড়লো-

জুতার ভেতর কেমন করে ছোট্ট একটা পাথর কুচি
ঢুকে আছে, খুব আয়েশে।
আমি এখন পথে পথে ব্যস্তথাকি, সমস্তদিন।
আমি এখন ভদ্রমানুষ, তাই থামিনা, থামতে মানা।

তবু আমার মোবাইল ফোনে, মৃত্যু এল তরঙ্গিত
আমার ঘরে পর্দা টানা, নতুন বাতাস ঢুকতে মানা
তবু দেখো, মৃত্যু কেমন ঘুরছে আমার ঘরটা জুড়ে।

একটা ছবি, একটা হাসি, ভালোমানুষ গোবেচারা।
মৃত্যু মানে আমার কাছে, হলুদ হওয়া একটা কাগজ
হারিয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া…
মৃত্যু মানে আর খুব জোড়, কয়েক ফোঁটা চোখের পানি,
বুকের মধ্যে একটুখানি, থমকে যাওয়া রুগ্ন বাতাস
আর কিছু না, আর কিছু না।

তবু যখন অন্ধকারে, অফিস পাড়া ঘুমিয়ে পড়ে।
আমি তখন গুটি গুটি, ফিরতে থাকি, ঘুরতে থাকি।
আমি তখন অন্ধকারে, একটা জানলা আলোকিত
যায় না ছোঁয়া, যায় না ছোঁয়া…

কিংবা যখন অফিস ঘরে।
জানলা বেয়ে গড়িয়ে নামে অন্ধকারের তরল শরীর।
নিয়ন বাতির বিশাল ঘোরে, নিরবতা ঘুরতে থাকে।
ব্যস্ত আমার আঙুলগুলো থমকে থামে,
কানের পাশে কার নিঃশ্বাস? হাসতে থাকে হাসন রাজা।
জুতার ভেতর পাথর কুচি, তুলতে মানা, যায় না থামা।

এখন দেখছি বানানগুলা কেমন উল্টা-পাল্টা হয়ে আছে… একদম শেষের দিকে একটা অফিস থেকে ফেরার কথা আছে… ঐ অনুভূতিটা মনে হয় আপনার মতোন…

নিয়ন্তি

-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-

নিয়ন্তি,
কবিতায় এতো মৃত্যু কেনো??
আমি এমনিতেই মরবিড হয়ে আছি। মৃত্যুচিন্তা করি না, এটা আসলে আমার অস্তিত্ব নিয়ে আজীবন ধরে চলমান ভয়, শঙ্কা। আমি নিজের অস্তিত্ব হারাতে খুব ভয় পাই। এজন্য কখনই মৃত্যু নিয়ে লিখি না। লিখতে পারিও না সেরকম!

আপনি আগে অনেক ‘ফ্লুয়েন্ট’ কবিতা লিখতেন। এখন লেখেন না কেনো?

বৃষ্টি নিয়ে আমার কলেজের একটা স্মৃতি মনে পড়লো। আমি তখন একটা কোচিংয়ে পড়তাম। এক স্যারের কাছে অঙ্ক, আরেকজনের কাছে কেমিস্ট্রি। একই গলিতে দু’জন স্যার, পড়ার টাইমটাও ছিলো পরপর। পড়া শেষ হলে হেঁটে হেঁটে বাসায় আসতাম।
ওটা পুরো ছেলেদের ব্যাচ ছিলো। তারপরে মেয়েদের ব্যাচে জায়গা হয়নি বলে দু’টা মেয়ে পড়তে এলো! আর সব ছেলেগুলা অতিরিক্ত এটেনশন দেয়া শুরু করলো, বুঝেনই সতের বছর বয়েস।
আমার কেনো জানি সতের বছরের তরুণীদের তখন থেকেই দূর্বোধ্য লাগতো। কথা, চাহনি, সবকিছু। তাই এড়িয়ে চলতাম। একজনের তাতে কৃপা হলো, আমার প্রতি নজর পড়লো। অন্য সব শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সে আমার সাথে যেচে কথা বলতো। আমি তাতে বিরাট বিব্রত হতাম, বিব্রত হলে আমার কান লাল হয়ে যায়। যারা জানতো ব্যাপারটা সেই বন্ধুরা বিরাট ক্ষেপানো শুরু করলো! আর ক্রমেই আমার মেয়েটার উপরে রাগ বাড়তো।

অগাস্ট সেপ্টেম্বরের দিকে, বৃষ্টি মৌসুমে একদিন এরকম ঝুম নামলো। আমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি ফুটপাত দিয়ে, খেয়াল করলাম মেয়েটা বড়ো কষ্ট করে ছাতা সামলে যাচ্ছে। প্রচণ্ড বাতাস! ছাতা শেষমেশ ভেঙেই গেলো উল্টা হয়ে। আই দৌড়ে ওটা কুড়িয়ে দিলাম আর কী বেকুবের মতো বললাম, ‘স্যরি’, যেনো আমি ওটা ভেঙে ফেলেছি!
মেয়েটা ঐ বৃষ্টির তোপের মধ্যেও হেসে ফেলেছিলো। তারপরে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে দ্রুত-হাঁটা। আমি আমার প্রায় খালি ব্যাগ (ওটার ভেতরে দুয়েকটা খাতা ছিলো) ওর মাথায় ধরলাম। মেয়েটা এমনভাবে তাকালো!!…।।

বাসায় ফিরে জ্বর, ঠাণ্ডা। কোচিং বন্ধ। তারপরে পরীক্ষা চলে এলো আর কোচিংটা বন্ধ করে দিলাম। পরীক্ষার পরে, মাঝে তিনমাস চলে গেছে, স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম একদিন দেখা করতে। মেয়েটা হতো অন্য কোনো কোচিংয়ে চলে গেছে। দেখা হয়নি আর কোনোদিন!

তখন বুঝিনাই, এখন বুঝি। এ ধরনের স্মৃতিগুলো মনে হয় মানুষকে অনেক বড়ো করে দেয়, পরিপক্ক করে দেয়। তখন যে ভাবালুতা কাজ করতো, মেয়েটার জন্য একটা করুণ কান্না পেতো মাঝে মাঝে। মনে হতো, ওকে একবার দেখতে পেলে বেশ হয়। জীবন নীরবেই শিখিয়ে দিচ্ছে, দেখা পেলে বেশ হতো না! তাতে আমার শেখা হতো না, যে মানুষের জীবনটাই এমন। ফ্রেম ফ্রেম সারি সারি মুখ, কিন্তু কেউই কারো আপন নয়!!

অনেক বাজে এখন। আপনার অফিস টাইমের বারোটা বাজাচ্ছি। স্মৃতিকাতরতা মার্জনা হউক!

রাইন

(চলবে)

৪,১১৬ বার দেখা হয়েছে

৭৩ টি মন্তব্য : “নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকঃ পর্ব ২”

  1. টুম্পা (অতিথি)
    পুরা রাস্তায় পাঁপড়ি ছড়িয়ে থাকতো আর আমি মাঝে মাঝে তুলতাম।
    চশমা নেয়ার আমারও শখ ছিলো জানেন?

    নাহহ এ তো খুব মুশকিল! এতো কিছু মিলে গেলে তো খুব সমস্যা :-/
    কবিতা খুব কম পড়ি। বুঝিনা,তাই...তারপর ও কবিতা টা আপন আপন লাগলো...

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    ফুলার রোডের ঐ পাড়া। ভিসির বাড়ি আর ইউনিভার্সিটির মাঝখানে একটা আইল্যান্ড ছিলো, তিনকোনা :(( :(( :(( হ ফুলার রোদেই তো,ব্রিটিশ কাউন্সিলের অপজিটে সি টু টাওয়ার ভবন :(( :(( আন্দাদা, কি মনে করায় দিলেন গো দাদা-আমার দীর্ঘশ্বাসে তো আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে দাদা... 🙁 🙁

    তবে হ্যাঁ,বর্তমানে বেইলী রোডে গেলে ফুলার রোডের দুঃখ ভুলে যাই :shy: :shy:

    জবাব দিন
  3. আগের পর্বে কমেন্ট করতে গিয়েও সময়ের অভাব এ করি নি।লেখা কেমন হয়েছে জানি না, পড়তে ভালো লাগছে, শান্তি শান্তি লাগছে।
    কেমিস্ট্রি আর ম্যাথ টিচার এর কথায় কেন জানি সিদ্ধেশরী কালিমন্দিরের পাশে বিশবজিত আর বিদ্যাসাগর স্যার এর কথা মনে পরে গেলো।
    জব লাইফ, চশমা এইসব তো পুরা আমার জীবন থেকে নেওয়া...

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      বলো কি! আমি দেখি সবার জীবন থেকে গল্প নেয়া শুরু করে দিলাম! এই অসম্ভব কার্য কি করে সম্ভব হলো?! 😐

      মেলিতা, টিচারদের ব্যাপারটাও আমার নিজের অভিজ্ঞতার সাথে মিলে গেছে। আমি যেখানে পড়তাম, সেখানেও দু'জন টিচার একই গলিতে কাছাকাছি জায়গায় পড়াতেন (এরকম টিচারগণ কাছাকাছি থাকতেন মনে হয় ছাত্র পাওয়ার সুবিধার্তে)!

      এরকম টুকরো টুকরো ঘটনা আসলে আমাদের সবার জীবনেই ঘটে গেছে মনে হয়। আমি কোনোটা শুনেছি, কোনোটা নিজে পেয়েছি। সব মিলিয়ে লিখছি। তোমার কমেন্ট পেয়ে খুব ভালো লাগলো।

      কেমন আছো?

      জবাব দিন
  4. দিহান আহসান
    মনে হয় যে আপনাকে আরো কত্তো আগে থেকেই চিনি… যখন চিনতাম না…
    অধিকারের কথা। অধিকারবোধ আর অধিকার এক জিনিস না, তাই না? বোধহয় একটা অনুরণনের মতোন… মাঝে মাঝে অধিকার জন্মাবার আগে থেকেই অনুভূতিটা থাকে… আবার শেষ হওয়ার পরও বাজতে থাকে।

    :thumbup:

    আহা!! কিভাবে লিখে ফেলো ভাইডি, মনের কথা?

    জবাব দিন
  5. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    সহজ ভাষায় সুন্দর করে লিখে যাচ্ছিস । বিফোর সানরাইয আর বিফোর সানসেট মুভি দু'টা দেখার সময় কেমন যেন স্বপ্নময় একটা অনুভূতি হচ্ছিল, এখনো সেরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে । যাই পরের পর্ব পড়ে আসি ।

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      সত্যি বলি, আমি এই সিরিজের দুইটা পর্ব লেখার পরে গল্প সংকটে ভুগছিলাম। তারপরে বিফোর সানরাইজ বের করে দেখলাম। দু'টা মানুষ সারা রাত ধরে এতো এতো কথা বলে কিন্তু কখনই তাদের মাঝে গল্প করাটা একঘেঁয়ে হয় না! এমন উদাহরণ দেখলে নতুন নতুন কথার বিষয় মাথায় আসে।

      আজকে বিফোর সানসেট ডাউনলোড দিলাম। অনেক আগে দেখেছিলাম বলে কাহিনী ভুলে গেছি। আবার দেখা লাগবে!

      ধন্যবাদ বস। অমন অনবদ্য ছবির সাথে এই লেখার অনুভূতি মিলালেন, আমি তো খুশি হই গেলাম! 😀 😀

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রেশাদ (৮৯-৯৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।