তুমি জানবেও না যে এই লেখাটা তোমায় নিয়ে…

আ,

ছোটবেলায় আমি একবার দৌড়ের রেসে নেমেছিলাম। অনেক প্রাণপণ দৌড়ে নিঃশ্বাসের শেষবিন্দুতে পৌঁছে দেখি আমি হেরে গেছি আরেকটা ঢ্যাঙা ছেলের কাছে। সেদিন ফিনিশিং লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আমার অনেক কান্না পাচ্ছিলো, ছোট ছিলাম। আবেগী ছিলাম। এখনও হতচ্ছাড়া আবেগ আমায় ছাড়ে না। সেদিন থেকে হারতে বড়ো কষ্ট হয় সবসময়।

বছরের বিশেষ দিনগুলোতে আমাদের কখনোই দেখা হয় না! এটা খুব অদ্ভুতভাবে তুমি একদিন বললে, কী নিয়ে যেনো আমাদের মধ্যে খুটখাট লেগে গেলো আর তুমি বললে, খুব ক্লান্ত স্বরে, যেন এই কথাগুলো বলতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে! বললে, “তুমি কি খেয়াল করেছো যে আমরা কোন উৎসবের দিনে, আয়োজনের দিনে, দিবসগুলোতে দেখা করতেই পারি না!” আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম হয়তো, তাই ভেবে দেখলাম যে আসলেই পারি না। কিন্তু এটা নিয়ে বলার কিছুই ছিলো না। দেখা না করার কারণ আমরা হইনি কখনো। পরিপার্শ্ব আমাদের কতোভাবে বেঁকেচুরে দেয়। সহস্র আকাঙ্ক্ষার গলা পরিস্থিতির চাপে বুজে আসে অনায়াসে, যেনো কোনো বাগানের মালি গাছে পানি দেয়ার নলটা অনায়াসে বুজে দিলো!

এক একটা বছর যায় আর আমি অবাক হই, কীভাবে বিস্তর বিস্তর স্মৃতি জমা হয়। আমি জন্মের পর থেকে এক একটা স্মৃতির ঘর বুনছি। কত হর্ষ, বেদনা আর বিরহ জমা হয়ে আছে, অমলিন আর্কাইভের মতো। কিন্তু তুমি এলে আর এসব ঘরের চাবি হারিয়েই ফেললাম আমি। টেরও পাই না যে সেই দুঃস্মৃতির ঘর আমার বুকের ভেতরে এখনও আছে!

দুর! আজকের দিনে কেনো আমি এসব বলছি। কিন্তু জানো তো, আমি কেমন মেলাঙ্কলিক-অ্যালকোহলিকের মতোন। মাঝে মাঝে রেট্রোস্পেক্টে নিজেকে দেখি, আর ভাবি আমি কীভাবে খাদের একটু পাশ দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে এলাম। তুমি সামনে ছিলে নিয়ত ঘূর্ণির বছরটা জুড়ে ছায়ার মতো একই গতিতে ঘুরেছি দু’জনেই। এতো দ্রুত দিনগুলো পেরিয়েছে যে মাঝে মাঝে টের পাই নিঃ আমি অনলাইনে একজনের সাথেই কথা বলছি, রোজ রোজ। প্রতিদিন। তুমিও খেয়াল করেছিলে? আমি কতটা অপেক্ষা করতাম, অপেক্ষার মুহূর্তে কী ভাবতাম এখনও সব জানি।

ঝকঝকে দোকানটার চেয়ারগুলো ঠাণ্ডা ছিলো, সেটা শীতের জানুয়ারি ছিলো। আমি কাঠ হয়ে বসে ছিলাম আর তোমার অপেক্ষা করছিলাম। তুমি একটা নীলচে বেগুনি জামা পরে আসলে, জামায় শাদা শাদা ফুল। এসে সামনের চেয়ারটা টেনে বসলে আর আমি জমে গেলাম। আমার হাতে একটা প্যাকেট ছিলো, প্যাকেটের ভেতরে পোকা ছিল। পোকা না, একটা ঝিনুক ছিলো। ছোট প্যাট্রিফায়েড ঝিনুক। ঝিনুকটা একটা চাবির রিঙের ভেতরে সারাজীবনের জন্যে আটকা পড়ে গেছে! আমি সেই প্যাকেটটা তোমার দিকে ঠেলে দেয়ার সময়ে একটু একটু কাঁপছিলাম মনে হয়। সেদিন তো বুঝি নি, সেই প্যাকেটের ভেতরের চাবির রিঙে আমার সবটুকু বাঁধা পড়ে গেছে…

তোমার সাথে এর পরে আমার যতোদিনই দেখা হয়েছে, আমি সেই কম্পনটা টের পেয়েছি। এটা কোনো বলার মতো বিষয় না, বরং হয়তো দুশ্চিন্তার বিষয়। আমি নিশ্চয়ই উদভ্রান্ত অসুস্থ কেউ! নাহলে কেনো আমি এমন সম্মোহিত হবো, কেনো একজনের চোখের দিকে তাকালে আমার আর কোনোকিছুই ভালো লাগবে না– তাকে ছাড়া। কেনো কারো খিল খিল হাসি শুনলে আমি মোবাইল কোম্পানিকে ধন্যবাদ দিবো আর সারাজীবনের জন্যে চার্লি চ্যাপলিনের চেয়ে বড়ো কমেডিয়ান হয়ে যাবো! কেনো সে ব্যস্ত আর পাঁচ মিনিটের বেশি দেখা করতে পারবে না জেনেও আমি ঠা ঠা রোদ্দুর অনায়াসে মাথায় মেখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবো! এতোসব কেনো বড়ো অস্থির করে আমাকে!

আমি জানি তুমিও আমার মতোই কাঁপো। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি এই খেলাঘরে তুমি আমার চেয়ে বেশি আমাকে ভালোবাসো। নিজের ওপর দাবি ছেড়ে দিয়েছি সেদিনই, চাবির রিঙের সাথে তোমাকে দিয়ে দিয়েছিলাম স-ও-ব!

এই প্রথম আমি হেরে গিয়ে অনেক খুশি হয়ে গেছি। এই প্রথম আমি জেনেছি সব দৌড়ে জিততে নেই। মাঝে মাঝে ফিনিশিং লাইনে সবচে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি দাঁড়িয়ে থাকে শুধুই আমার জন্যে…

৮,৩৩৫ বার দেখা হয়েছে

৭১ টি মন্তব্য : “তুমি জানবেও না যে এই লেখাটা তোমায় নিয়ে…”

  1. জিহাদ (৯৯-০৫)

    পড়তে পড়তে আবেগে ইমোশনাল হয়া মাথায় এন্টেনা আর কোমরে বেল্ট বাঁধতে ভুইলা গেসিলাম।

    পড়ার শেষে এসে মনে হইলো হায় হায়, এন্টেনা আর বেল্ট ছাড়া কেমনে সব বুইঝা ফালাইলাম 😀

    অনেক রোমান্টিক লেখা। নস্টালজিক 🙂


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  2. রাফাত (০২-০৮)

    " পরিপার্শ্ব আমাদের কতোভাবে বেঁকেচুরে দেয়। সহস্র আকাঙ্ক্ষার গলা পরিস্থিতির চাপে বুজে আসে অনায়াসে, যেনো কোনো বাগানের মালি গাছে পানি দেয়ার নলটা অনায়াসে বুজে দিলো!"

    মারাত্তক লাগল।এত সুন্দর ক্যামনে লেখেন? :salute:

    জবাব দিন
  3. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    তপন চৌধুরীর একটা গানের কথা ছিল...
    "তারপর কোন এক জলসাতে,
    গান গেয়েছিলে তুমি আমারি সাথে...
    ইচ্ছে করে আমি হেরেছি সেদিন,
    কত খুশী হবে তুমি এটুকু ভেবে..."

    ব্যাপারটা এখন দেখছি আসলেই সত্যি...

    জবাব দিন
  4. অসীম (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভেবেছিলাম এখন আর কেউ চিঠি লিখে না দাপ্তরিক প্রয়োজন ছাড়া। এই ভেবে কষ্ট হত, আমার খুব প্রিয় একটা জিনিস পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। ডিজুস টাইম। এভাবে প্রিয় মানুষকে এখনো কেউ লিখে। খুব ভাল লাগল। থ্যাঙ্কস আন্দালিব। ক্যাডেট ছাড়া অন্যরাও লিখে নাকি এখনো? :thumbup:

    জবাব দিন
  5. হুমায়রা(২০০২-২০০৮)

    "এই প্রথম আমি জেনেছি সব দৌড়ে জিততে নেই ।মাঝে মাঝে ফিনিশিং লাইনে সবচে কাংখিত মানুষটি দাঁড়িয়ে থাকে শুধু আমারি জন্য..............." :thumbup: :thumbup:
    স্যরি......।বানান ভুল আছে............ 🙂 🙂

    জবাব দিন
  6. দিহান আহসান
    মাঝে মাঝে ফিনিশিং লাইনে সবচে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি দাঁড়িয়ে থাকে শুধুই আমার জন্যে

    আন্দা চমৎকার করে লিখলে ভাইয়া। 🙂

    বেল্ট-এন্টেনা ছাড়াই বুইঝা ফেলাইসি 😛

    জবাব দিন
  7. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    আন্দালিব ভাই :just: অসাধারণ :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  8. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    অনেকদিন পরে একটা লেখা দিলি (তোর রিভিউ গুলাকে লেখা হিসেবে ধরছিনা 😛 ) লেখার প্রথমে আর শেষে লেখা কেন? লেখা নিয়ে কি বলব আবেগের দারুন প্রকাশ । এই লেখা গুলোর মাঝে কেমন একটা কবিতা কবিতা ভাব । রেট্রোস্পেক্টে এর ভালো বাংলা কি হবে ? যাকে নিয়ে লিখলি তাকে পাঠাতে ভুলিসনা আবার 😀

    জবাব দিন
  9. জাহিদ (১৯৯৯-২০০৫)

    পড়তে পড়তে ভাবতেছিলাম আন্দালিব ভাইয়ের লেখা মি একাই বুঝতেছি। কিন্তু কমেন্ট পড়তে গিইয়ে কেম্নে কি? 😮 😮
    সহজ এবং অসাধারণ লেখা দেবার জন্য :hatsoff: :hatsoff:

    জবাব দিন
  10. আজহার (২০০০-২০০৬)
    এই প্রথম আমি হেরে গিয়ে অনেক খুশি হয়ে গেছি। এই প্রথম আমি জেনেছি সব দৌড়ে জিততে নেই। মাঝে মাঝে ফিনিশিং লাইনে সবচে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি দাঁড়িয়ে থাকে শুধুই আমার জন্যে…
    এককথায় অসাধারন। :hatsoff:
    জবাব দিন
  11. এই প্রথম আমি হেরে গিয়ে অনেক খুশি হয়ে গেছি। এই প্রথম আমি জেনেছি সব দৌড়ে জিততে নেই। মাঝে মাঝে ফিনিশিং লাইনে সবচে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি দাঁড়িয়ে থাকে শুধুই আমার জন্যে…

    জোসসসস...
    ভাইয়া, অসাধারণ!! আমি একশ্বাসে তিনবার পড়লাম...

    :dreamy: :dreamy: :dreamy:
    এরকম চিঠি পাইতে খুব খুব মঞ্চায়... 🙁 🙁

    জবাব দিন
  12. শাওন (৯৫-০১)
    এই প্রথম আমি হেরে গিয়ে অনেক খুশি হয়ে গেছি। এই প্রথম আমি জেনেছি সব দৌড়ে জিততে নেই। মাঝে মাঝে ফিনিশিং লাইনে সবচে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি দাঁড়িয়ে থাকে শুধুই আমার জন্যে…

    আমিও চাই এমন কিছু.....কিন্তু আমার ফিনিশিং লাইনে আমার জন্য কেউ দাড়িয়ে থাকেনা......হয়তো সে অন্য কারো... 🙁


    ধন্যবাদান্তে,
    মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শাওন
    প্রাক্তন ক্যাডেট , সিলেট ক্যাডেট কলেজ, ১৯৯৫-২০০১

    ["যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি"]

    জবাব দিন
  13. সামিয়া (৯৯-০৫)

    পড়তে পড়তে আবেগে ইমোশনাল হয়া মাথায় এন্টেনা আর কোমরে বেল্ট বাঁধতে ভুইলা গেসিলাম।

    পড়ার শেষে এসে মনে হইলো হায় হায়, এন্টেনা আর বেল্ট ছাড়া কেমনে সব বুইঝা ফালাইলাম

    অনেক রোমান্টিক লেখা। নস্টালজিক 🙂

    জবাব দিন
  14. সামিয়া (৯৯-০৫)

    হ পরথম পরথম ওই পাঁচ মিনিট ঠা ঠা রোদ্দূরের মধ্যে আপনিই দাঁড়াবেন গিয়া ...ার সারাজীবন সেই কথাই বুক ফুলায়ে বলবেন

    পাঁচ মাস মাস পর থেকে দাঁড়াবে আরেকজনে 🙁

    জবাব দিন
  15. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    আন্দাদা, আপনাকে আর কি বলব! অসাধারন একটা প্রেমময় লেখা।

    লেখার ধরনে সামান্য পরিবর্তন এনেছেন মনে হচ্ছে। আমার ভুলও হতে পারে, কিন্তু আগের লেখাগুলার সাথে কিছু একটা পার্থক্য আছে বলে মনে হচ্ছে।

    জবাব দিন
  16. আমার ঘাসফুল(আমার কাছে সংজ্ঞাহীন মানুষটি) আমার ১৬ বছরের জন্মদিন-এ পলাশ ফুলের মতো দেখতে একটা চাবি রিং দিয়েছিল। সেই ঘাসফুলের এই বৈশাখেই বিয়ের ফুল ফুটবে। আপনাকে ধন্যবাদ সম-স্মৃতি আগলে রাখার জন্য

    জবাব দিন
  17. রকিব (০১-০৭)

    পুরান লেখা, কিন্তু প্রতিবার নতুন করে ভালো লাগা দেয়। আন্দাদে, তো ফিনিশিং লাইন টাচ করে ফেললেন :clap:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামিয়া (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।