গল্পঃ রোদ ভেঙে যেদিন পেরুলো সবাই অনন্ত রাত

দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বের হয়ে আসার পরে পিঠের ওপরে সেটা দড়াম করে চিৎকার করে উঠলে রাসেলের মনে হয় এভাবে সব দরজাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সাদা-কালো কাচে তৈরি দরজায় এধরনের শব্দ হয় না বলে সে প্রায় ভুলতে বসেছিল, কিন্তু আজ পেছনে দড়াম করে দরজা পড়ার শব্দটা তাকে মনে করিয়ে দিলো প্রত্যাখ্যান কতো নিষ্ঠুর। দুপুরের রোদ বেহিসেবি অ্যাকাউন্টেন্টের মতো অবারিত ভুল তীর ছুঁড়ছে, আর পিঠে থুথুর মতো লেপটে থাকা শব্দটা, যেটা জড়িয়ে ছিলো, সেটাকে এলোমেলো করে দেয়ার চেষ্টা করছে। অদ্ভুতভাবে, এমন কাঠফাটা রোদে, রাসেলের ভেজা ভেজা লাগে।

অনাহিতার টানাপোড়েনের গল্পটা তার থেকেও জটিল, কুটিল। কথার পিঠে কথা বলতে বলতে আমরা যেমন একটা সময়ে ভুলে যাই কোথায় কথা শুরু হয়েছিলো, তেমন করে অনাহিতারও মনে নেই সবকিছু। অনেক কথার গায়ে অনুভূতির ছাপ মারা থাকে, লাল নীল রঙের পোস্টারের মতো অনুভূতির দাগ থাকে বলে সেগুলো মনে পড়ে যায় সহজেই। প্রথম যেদিন ‘ভালোবাসি’ শব্দটা ফিসফিসিয়ে শোনা যায়, তার প্রতিটা কম্পাঙ্কের সাথে, স্বরের ওঠানামার সাথে সীল-গালা করে কি কি অনুভূতি মিশে যায়! হর্ষ। বিষাদ। আকুলতা। অধীর আবেগগুলো অনাহিতা মনে করতে পারে। এখন যেভাবে রাসেল সবকিছু ভেঙে বেরিয়ে গেলো, তখন তার যাবার ছবিটা দেখতে দেখতেই জোরে দরজা লাগিয়ে অনাহিতার অনেক বেশি মন খারাপ হয়ে যায়। তারপরে সে আলগোছে সব চিন্তার ঝুলঝুলে ভাঁজে বিড়বিড় করতে থাকে, “তুমি ফিরে আসো, তুমি ফিরে আসো প্লিজ”।

তার ফিসফিসানি একা একা ঘরের চারকোণে প্রতিফলিত হতে থাকে। শব্দগুলো টেনিস বল। দেয়ালে লেগে ফিরে ফিরে অনাহিতার মুখে, চুলে, হাতে মেখে যেতে থাকে।

প্যান্টের ঝুল টানাটানি করা কালো পিচ্চিটাকে রাসেলের উৎকট ঘিনঘিনে লাগছিলো। রিকশায় বসে বসে তার মনে হয় একটা ঝেড়ে লাথি কষানো দরকার। পিচ্চিটার পেছনে বেশি জায়গা নেই, ঠিকমতো লাগলে উড়ে গিয়ে সামনের রিকশার পা-দানিতে পড়বে। কিন্তু লাথি না মেরে শেষপর্যন্ত সে হাঁটুটা একটু নাড়ায়, পিচ্চিটা খানিক পরে হতাশ হয়ে চলে যায়। রোদ কমছে না। দীর্ঘ শ্লথ জ্যামের মধ্যে রাসেল ভাবে কেন সে কচ্ছপ হলো না। খোলের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দিব্বি গড়াগড়ি দেয়া যেত। গুটিয়ে রাখা হাতার ভেতর ঘাম জমা হচ্ছে, ধীরে ধীরে শিশিরের মতো ভিজে উঠছে, হাতা জুড়ে বদ্বীপ-মানচিত্র। আর ঠিক সেই সকাল সকাল অনাহিতাকেই মনে পড়ে তার। এমন হুটহাট কাউকে মনে পড়ে যাবার ব্যাপারে একটা আইন থাকা উচিত, –ভাবে রাসেল, ঘামের গায়ে কি অনাহিতার নাম লেখা ছিলো? যেভাবে সে শার্টের কোনাটা আঁকড়ে ধরতো, সেভাবে কেন ঝটকা দিয়ে রাসেলের তাকে মনে পড়ে? নাহ, পিচ্চিটাকে লাথি কষালেই ভালো হতো…

সেদিন রোদ ছুঁড়ে রাসেল গাছের ছায়া খুঁজছিলো। সেগুলো এই শহর থেকে হারিয়েই গেছে, নাকি কেউ একদিন ভোজবাজির মতো ডাকাতি করে নিয়ে গেছে কি না কে জানে। তবে রাসেল কোন গাছ খুঁজে পায় না, আর তারপরে সে উদয় টাওয়ারে ঢুকে পড়ে। এখানে তার চাকরি, অর্থাৎ অফিস নামের একটা জীবন। সেখানে সপ্তাহে পাঁচদিন সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সে দশঘন্টা কাটায়। এসি’র বাতাসের দমকে দমকে তার মনেও পড়ে না কীভাবে সকাল গড়িয়ে গড়িয়ে বিকেল হয় বা কীভাবে সে যখন উদয়ের পেট থেকে বের হয় তখন সূর্যের চেহারাও বাইরে নজর পড়ে না। রিসেপশনে সুমাইয়া বসে, পৃথুলা গড়নের সুমাইয়াকে শীতাতপ অফিসে বেশ ভালো লাগে তার। অনাহিতাকে কি তখন একবার মনে পড়ে? নাকি সুমাইয়া বাম হাতে আলগা চুলগুলো গুটিয়ে কানের পেছনে নিলে, তার বিভ্রান্তি বাড়ে আর মনে হয় স্বচ্ছ কাউন্টারের পেছনে দুরন্ত অনাহিতা বসে আছে! তারপরে রাসেলের কেন জানি সুমাইয়াকে জড়িয়ে ধরতে হঠাৎ ইচ্ছা করে। কিন্তু সে’রকম কিছু না করে সে মাথা দুলিয়ে, হাসি মেখে কার্ড পাঞ্চ করে ভেতরে চলে যায়। তার পিঠের পেছনে শ্যানেল ফাইভ মাখিয়ে দেয় সুমাইয়া। এত দামি পারফিউমটা ও কোত্থেকে কিনেছে?

অনাহিতা দুপুরে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুমের মধ্যে তার মনে হচ্ছিলো সে জেগে আছে। জেগে থাকার যে সাধারণ অনুভব, সেগুলো তার হচ্ছিলো বলে সে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলো যে সে জেগেই আছে। অনাহিতা হাঁটছিলো একটা ফাঁকা করিডোর দিয়ে। করিডোরের একপাশ দিয়ে অনেকগুলো বিছানা, বিছানায় অনেকগুলো শরীর কাতরাচ্ছে। দুয়েকটা শরীর প্রায় নিথর হয়ে পড়ে আছে। একটা শরীর ঝলসে কালো হয়ে গেছে আর সেটার গা দিয়ে ভকভক করে পোড়া মাংশের গন্ধ পায় সে। তখন তার মনে হয়, এটা স্বপ্ন হলেই ভালো হতো। আর ঠিক এই ভাবনার সাথে সাথেই তার ঘুম ভেঙে যায়। কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে সে বোঝার চেষ্টা করে। জোরে একটা শ্বাস নেয়, উঠে বসে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। এখন অনাহিতা কাঁদছে অথচ তার কাছে কেউ নেই, কেউ তার পাশে বসে তাকে একটু সান্ত্বনা দেবার নেই, তার শোকের ভার হালকা করবে এমন কেউও নেই। রাসেলকে তার মনে পড়ে খুব, খুব করে সে বারবার ভাবে রাসেল এখন কোথায়? কাঁদতে কাঁদতে যখন সে প্রতিবার নিঃশ্বাস নেবার জন্যে থামে, তখন হয়তো সে আশা করে এই নৈঃশব্দ্য রাসেল ভরাট করে দিবে। কিন্তু সেখানে শুধুই নীরবতা জমে থাকে!

অফিসের ভেতরে গেলে রাসেলের কেবলই মনে হতে থাকে সে কোন শীতল জরায়ুর ভেতরে ঢুকে পড়েছে। যেন সেটার ভেতরে অনেকগুলো প্রকোষ্ঠ, খোপ খোপ করে রাখা। প্রতিখোপে একজন করে শুক্রাণু আর মাঝে মাঝে কোন কোন খোপে ডিম্বাণু হাসিখুশি, খুব ব্যস্ত হয়ে নড়াচড়া করছে। রাসেল দরজা পেরিয়ে নিজের খোপে গিয়ে একটা শুক্রাণু সেজে বসে। অথবা সে ডিম্বাণুও হতে পারে, এ বিষয়ে দ্বিধা ও সন্দেহ পাশাপাশি খেলে।

খোপের দেয়াল কথা বলে ওঠে, “কি খবর রাসেলমিঞা?”।

দেয়ালের ওপাশ থেকে এক শুক্রাণু ইসলাম ভাই বলছেন, “আজকের প্রেজেন্টেশন কদ্দুর?”

রাসেলের কপালে ভাঁজ পড়তে পড়তে মিলিয়ে যায়, নিঃশ্বাস বেঁধে রেখে সে কাগজ গুছিয়ে ইসলাম ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দেয়, “দেখেন তো ঠিকঠাক হইসে কি না?”

নতুন প্রজেক্টের কয়টা দিন এ’রকমের লঘু ব্যস্ততা তার খারাপ লাগে না। আবার মাঝে মাঝে ভুস করে খিদে লেগে গেলে কাজটুকু মুলতবি রেখে তার বেড়িয়ে আসতে ইচ্ছা করে খুব। রাসেল লাঞ্চ করতে করতে ট্যুরের প্ল্যান করতে চেষ্টা করে। আজকে লাঞ্চের মেন্যু খুব খারাপ, রুই মাছের পেটি ধরনের একটা কিছু ঝোল ঝোল তরকারিসহ ভাসছে। বাটিটা ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে তার। তারপরে সেটা থেকে টুকরাটা পাতে নিয়ে সে মোনায়েম ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায়। মোনায়েম ভাই হাত ডুবিয়ে ঝোল মাখাচ্ছেন, ঝোল টেনে আঙুল চাটছেন, তারপরে বলছেন, “রাসেল, এবারে ট্যুরে যাওয়া হবে না। তোমার ভাবী এক্সপেক্টিং।”

ঝোল চেটে ফেলা দুটো আঙুল দেখিয়ে তিনি বিগলিত হাসেন কিছুক্ষণ। বিজয়ের চিহ্ন দিয়ে তিনি “দুই নম্বর” বুঝালেন, নাকি “জিতে গেছি” বুঝালেন তা রাসেল ঠিক ঠাহর করতে পারে না। তারপরে দেখে কর্পোরেট এফেয়ার্সের তিনটা মেয়ে ঝুমঝুম করে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। মোনায়েম ভাইয়ের “ভি” সাইনের পাশ দিয়ে একটা মেয়ের ডান স্তনটা ঝুলে থাকে। ‘ফ্রেমটা রুইমাছের ঝোল মাখা হলে আজকের লাঞ্চ খাওয়া জমতো’, এমন ভাবে রাসেল। খাওয়ার পরে তার মেয়েটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হয়। মেয়েটা কেন হাতে মেহেদি মাখে প্রতিসপ্তায় তাও জানতে চায় রাসেল। অনাহিতা কেন মেহেদি মাখতো?

এভাবে প্রায় সারাদিন ধরেই রাসেলের অনাহিতাকে মনে পড়ছে। অনাহিতার গল্পটুকু ঠিকঠাক তার মনে নেই সম্ভবত। অথবা সে সেসব কথা মনে করতে চায় না। কারণ সেগুলো মোটেই জরুরি না। অনাহিতা হারিয়ে গেছে বলে ধারণা করে সে — এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার বিকেলের প্রেজেন্টেশনের চাইতেও! সন্ধ্যার পরে উদয় চিরে বের হয়ে রাসেল দেখে সুমাইয়া দাঁড়িয়ে আছে, পৃথুলা। রাসেলের তাকে রাস্তার আলোতে দেখতে ভালো লাগে, সুমাইয়া ওর দিকে তাকায়। স্মিতহাসি মেয়েটার মুখে এখন একটুও হাসি নেই, সে মনে হয় অনেক ক্লান্ত। রাসেলের খুব ইচ্ছা করতে থাকে এগিয়ে গিয়ে একটু কথা বলার, একটু হাসিমুখে তাকানোর।

তারপরে যখন সন্ধ্যা ভেঙে অনাহিতার কান্না থামে, তখন বাসায় অনেক লোক। আজকে সবার দাওয়াত ছিলো। অনাহিতার জন্মদিন আজকে কিন্তু তার আজ কিছুই ভালো লাগছে না। গত বছর থেকেই জন্মদিনের দিনটায় তার কষ্ট হয়, সে গতবছরেও এভাবে কান্নাকাটি করেছিলো। সেদিনও সবাই ছিলো তার বাসায়, রাসেলও ছিলো। সেদিন রাসেলকে দেখে সে ঠিকমতো চিনতেও পারে নি। একটা মানুষ এতো বদলে যায় কীভাবে! তার চেয়েও বড়ো বিস্ময়, হঠাৎ করে যখন আপন মানুষের বদল টের পাওয়া যায় আর জানা যায় যে এটা অনেকদিন ধরেই ঘটেছে, তখন নিজের বোকামিতে বিস্ময়বোধ করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। পাশাপাশি থাকার সময়ে কি তাহলে খেয়াল ছিলো না? রাসেলের বদলগুলো কেনো তার চোখে পড়ে নি?

প্রথম দিকে অনাহিতা ভেবেছিলো এসবই একটা নিছক দূর্ঘটনা। গত জন্মদিনের সবকিছুই একটা বড়োসড়ো দূর্ঘটনা আর সেই বিশ্বাসে সবার সাথেই সে কথা বলেছিলো সেদিনের ঘটনা জানার জন্যে। টুকরো টুকরো জবানে যা জেনেছে, তাতে তার দ্বিধা কেটে গিয়েছিলো আর পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে রাসেল আদতেই তার চোখের সামনে থেকে একটু একটু করে বদলে গিয়েছিলো। মনের কোণে কালো মেঘের মতো যে সন্দেহ জমা হয় সেটার বর্ষণ মানুষকে খুব পোড়ায়। অনাহিতা পুড়ে পুড়ে ঐ লাশটার মতো কালোকয়লা হয়ে গেছে এক বছরে। এখন তার ত্বকে কোন সাড়া লাগে না। মানুষের কথা, সান্ত্বনা, করুণা, সবকিছুই যেনো ভেসে ভেসে চলে যায় আঁচড় কাটতে না পেরে।

:” জীবন তো আর থেমে থাকে না।”
:”আবার সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করো।”
:”এভাবে আর কতোদিন থাকবে? তোমার বয়স কম।”

টুকরো টুকরো কথাগুলো বিষের তীর নিয়ে অনাহিতার দিকে ছুটে আসে, তার মুখে আছড়ে পড়ে। দুপুরের একলা একলা কান্না আবার ফিরে আসতে চায়। কিন্তু সামাজিক মুখোশটা চমৎকার এঁটেছে সে আজকে। তাই হাসিমুখে মুখ টিপে পিছলে যায় অনাহিতা, এসব কথা আঁশের মতো গায়ে লেগে থাকে কিছুক্ষণ। রাতের খাবার খাওয়া হলে, যখন সবাই একে একে বিদায় নেয়, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আবারও কিছু কথা বলে। দুয়েকটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কেউ কেউ গায়ে হাত বুলায় মায়াভরে। তারপরে আবার দরজা আটকে অনাহিতা একা হয়ে যায় আর তার গা থেকে আঁশটে কথাগুলো খুলে ফেলে। মুখের হাসিটা আর মুখোশটা খুলে হালকা লাগে তার। তারপরে আবার দমকে দমকে কাঁদতে থাকে সে। একা।

রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ইউনিভার্সিটির ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কথা মনে পড়ে অনাহিতার। বন্ধুরা জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো ঈষৎ বিব্রত অনাহিতাকে, ম্যুভিটার নাম ছিল ‘রশোমন’। দেখার পর থেকে তার মনে হচ্ছিলো ঘটনাটা এমন বদলে গেলো কেনো সবার কাছে? একইভাবে ভাবলে এমন কি সমস্যা ছিলো? আগে নাম না জানা ম্যুভিটা তারপরে শুধুমাত্র গল্পের জোরেই অনাহিতার মাথায় অনেকদিন ঘুরঘুর করেছিলো। রাসেলের গল্পটাও তার কাছে তেমন জটিল কুটিল হয়ে গিয়েছে তার কাছে। নিজের মনে মাঝে মাঝে অনাহিতা সবটুকু মেলানোর চেষ্টা করে। নিজের মনকে দুইভাগে ভাগ করে যুদ্ধে লাগিয়ে একটা মীমাংসায় আসার অনেক অসাধ্য চেষ্টা করতে থাকে সে। তারপরে একটা সময় ক্লান্তযুদ্ধ থেমে গেলে টের পায় আসলে কিছুই মিলে নি। কেবল রণভূমি জুড়ে তার রক্ত, তার লাশ কাতর পড়ে আছে। তার একা হয়ে বসে থাকার মাঝেই তার মনে হতে থাকে যে পাশে রাসেল এসে বসেছে। হয়তো সত্যিই রাসেল চলে এসেছে, “এখনও ঘুমাওনি?”

– “নাহ”

-“ঘুমাও”, বলে রাসেল তার মাথায় হাত বুলায় হয়তো। একটা শব্দ। একটা ছোট শব্দেই অনাহিতার মনে হয় সবটুকু অশ্রু বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। সে ঘুমিয়ে পড়ার আগে বুঝতে পারে তার পাশে রাসেল নেই। তবে রাসেলের হাতের ছোঁয়াটুকু আছে। অনাহিতা ঘুমিয়ে পড়ে।

গল্পের শুরুটা দরজা থেকে। দরজা দু’পাশে দু’জন মানুষ দাঁড়িয়েছিলো, তারপরে দু’জনেই সেই দরজা ধরে একসাথে টান দিয়েছিলো। অনাহিতার অবাক হয়ে খেয়াল করলো টানা সত্ত্বেও দরজা উল্টো ওকে টেনে নিয়ে গেলো! তারপরে বুঝলো ওপাশের মর্তমান কলাটিই এজন্যে দায়ী। সেই ছেলেটির সাথে এভাবেই তার দেখা হয়েছিলো। আর তার বছর পাঁচেক পরেও তারা একসাথেই ছিলো। তারও কিছুদিন বাদে তারা নিশ্চিত হয়েছিলো যে তারা আর একসাথে থাকতে পারবে না।

রাসেল যখন অসহায় বোধ করে, তখন খুব রেগে যায়। এই উড়নচণ্ডী রাগের কারণে তাকে অনেক সময় বড়োসড়ো ক্ষতিও সহ্য করতে হয়েছে। অনাহিতার সাথে যেদিন তার শেষ দেখা, সেদিন মোটামুটি জোর করেই দেখা করেছিলো। হয়তো বিচ্ছেদ মেনে নিতে তার মন চাইছিলো না, হয়তো এটাকে সে নিজস্ব দোষ ভেবেছিলো। যে’রকমই হোক না কেন, সেদিন খুব রেগে বলা কথাগুলো অনাহিতা এখনও মনে রেখেছে। প্রথম ‘ভালোবাসি’ বলার সাথে যেমন কোমল শিশিরের মতো অনুভূতিগুলো জড়িয়ে থাকে, সেদিন বলা কথাগুলোও অনাহিতার মনে ছিলো গনগনে আঁচে পুড়ে যাবার মতোই।

তিনদিন পরে সে যখন হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো তখনও সেই আঁচভরা কথাগুলো তার মাথায় ঘুরছিলো। কেন সেদিন অমন করে রাসেল বেরিয়ে গিয়েছিলো? করিডোরে সারি সারি শরীর, গলে ওঠা, ক্ষয়ে যাওয়া শরীরের ভীড়ে রাসেলের কালো হয়ে যাওয়া শরীরটা খুঁজে পেলে অনাহিতা থেমে যায়। তারপরে স্থানুর মতো সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তারও অনেকগুলো মুহূর্ত পরে অনাহিতার মনে হয় কালো শরীরটা সেই কথার আঁচেই হয়তো পুড়ে গেছে। রাসেলের শরীর জড়িয়ে ধরে সে ফিসফিস করে কী কী বলেছিলো সেগুলো আর শোনা যায় নি।

***
১০ নভেম্বর, ২০০৯

উৎসর্গঃ আদনান ভাই

১,৫৯৭ বার দেখা হয়েছে

৩৮ টি মন্তব্য : “গল্পঃ রোদ ভেঙে যেদিন পেরুলো সবাই অনন্ত রাত”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    মন খারাপ করা গল্প...

    ভালো কথা, নামের ব্যবহার একটু বেশি মনে হল... :-B
    সর্বনামকে হেলা করিও না... ;))
    ছেলেটা খারাপ না... 😛


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      সর্বনাম! হুমম। নামটা অনেক পছন্দ হয়েছে, তাই বেশি বেশি লিখে ফেলেছি মনে হয়! :shy:

      কেউই আসলে পুরোপুরি ভালো বা খারাপ হয় কি, কবীর ভাই? ভালো খারাপ দুটা খুব কনট্রাস্ট জায়গা। আমরা বেশিরভাগ মানুষ তো, মাঝামাঝি ধূসর একটা অবস্থানে থাকি। আর সম্পর্কে এগুলো আরো তালগোল পাকিয়ে যায় মনে হয়... 😕 😛

      জবাব দিন
  2. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    অনেকদিন পর একটা গল্প পড়ে থম মেরে বসে থাকলাম অনেক্ষণ। এক কথায় অসাধারণ লাগল। গল্পের বিল্ড আপ খুবই সুন্দর লেগেছে, তাই শেষ প্যারায় এসে মন কেমন যেন করে উঠল। আমার কাছে মনে হয়েছে শেষ প্যারাটাতেই আন্দালিব ভাই গল্পটা বলতে চেয়েছেন, বাকী প্যারাহুলো শুধুই বিল্ড আপ। ভুল বুঝলাম কি আন্দা ভাই?

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      শেষের গল্পটা সবার শেষে এসেছে, জানো? আমি ভাবছিলাম কি কি হতে পারে দু'জন মানুষের সম্পর্কের মাঝে। ভাবতে ভাবতে মনে হলো অনেক সময় সম্পর্ক খুব বেশি জটিল হয়ে গেলে, সেখানে একজনের প্রস্থানই হয়তো সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান। হয়তো সেই কারণে আরেকজনের মনে পুরনো ছবিটাই টিঁকে থাকে, তাতে তার জন্যে ব্যাপারটা কম কষ্টের।

      তোমার বোঝাতে ভুলে নাই। 🙂

      জবাব দিন
  3. আদনান (১৯৯৪-২০০০)
    সেদিন রোদ ছুঁড়ে রাসেল গাছের ছায়া খুঁজছিলো।

    এখানে তো মনে হয় ছেড়ে লিখতে চেয়েছিলি ।

    অথবা সে সেসব কথা মনে করতে চায় না।

    অথবা সেসব কথা সে মনে করতে চায় না। বললে কি বেশি ভাল লাগে না? জাস্ট একটা সাজেশন ।

    অনাহিতা হারিয়ে গেছে বলে ধারণা করে সে — এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

    এ লাইনটার বাক্য গঠনটাও ঠিক মনমতন লাগছেনা । আরেকবার দেখিস । আর গল্পটা আমার খুবই ভাল লেগেছে । চমতকার বিষয়বস্তু । এটাকে আধুনিক গল্প বলে কিনা আমি বলতে পারবনা, তবে আমাদের সময়ের কথা যে বলে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই । এরপর তোর কাছথেকে চাঁছাছোলা বাস্তবতা নিয়ে একটা গল্পের দাবী জানিয়ে যাচ্ছি । আরো জটিল চরিত্র নিয়ে আমাদের সামনে গল্প নিয়ে আয় । পড়ে আরো মজা পাই 😀

    জবাব দিন
  4. রাজীউর রহমান (১৯৯৯ - ২০০৫)

    এক কথায় বলি ভাই, "অসাধারন " :boss: :boss:

    আপনার গল্প পড়তে পড়তে কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছিলাম ।

    লেখার কথা বলি । বাক্যগঠন এবং মনের ভাব প্রকাশে অনবদ্য ক্ষমতা আপনার। লেখনী ও খুব সাবলীল । এই রকম লেখা আরো আরো চাই। :salute:

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      অনেক ধন্যবাদ রাজী। আমি গল্প খুব বেশি লিখি না। আসলে গল্প লেখার জন্য অনেক প্রস্তুতি বা চিন্তাভাবনা করা লাগে যেটা আমাকে কষ্ট করে করতে হয়। সে তুলনায় কবিতা অনেক সহজে লিখতে পারি।

      কিন্তু তোমার মন্তব্যে আসলেই উৎসাহ পাচ্ছি! অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোমার জন্যে।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : দিহান ইসলাম

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।