কবিতা-সিরিজঃ সে

অনেকদিন হয় আমি দীর্ঘ লেখা লিখি না, অনেক গভীর রাত জাগি না একা একা। অনেকের মনের সুখ আমাকে এখনও দোলায়, আমি নিজেকে পুরোপুরি আলাদা করে ছিঁড়ে বেরিয়ে একা একা হতে পারি না। এইসব অনভ্যাস আমাকে জংধরা ধাতব বানিয়েছে, আমি সেই মরফোসিস দেখেও নীরব ছিলাম। নীরবতা হিরন্ময় শুনেছি। চুপ থাকাই ভালো, কারণ সবাই বদলে যাবেই। বদলানোর পরের দিন ঘুম ভেঙে সবাই একটা নতুন পৃথিবী তৈরি করবে। আমিও তাদের সাথে যাবো!

সে সিরিজ

এক.
সে আসছে – উদ্দেশ্যবিহীন,
সে দ্রুত হাঁটছে, সে ধীরে মরছে – এমন মরণ!
বাসের গা ঘেঁষে সে চলে যায়, বাস অনড়োস্থির
শেষ জানালায় মাথাটি বেরিয়ে আসে ঘোলাটে থুতু
ছুঁড়লে সে চকিতে হয়েছে ধীর– কিংবা সরল

দুই.
চাঁদ মেঘের পিঠের পেছনে চুপ; উঁকি দিবে না বুঝে
সে খুব অবলীলায় খুন করছে আয়নাজগৎ
টুকরো টুকরো ধুলো আর প্রকাণ্ড রোদ অনায়াসে
নাভিপথে ঢুকে পড়ে! আঃ শীতলরহিত-গমন

তিন.
এসব কয়েনেজ রেখে মাথা নাড়ে সে, এসব ফাঁকিবাজি ছাড়ো
মাথা নাড়ে সে আর বলে, ‘আমার ভেতরে জ্বলে কোমল-সকাম-আমি,
আর এ-সকল কয়েনেজ শিরাভেদী গতিতে আমাকে মারছে’,
মরে গেলো সে, অথচ তখনও মেঘ ও চাঁদ ও বাস ও মাথা ও থুতুটি

…ল
…….ম্ব
………..ঝু
…….ল
…ছি

চার.
নদী বেঁকে শুয়ে থাকে, সেটা নিয়ে কারো আপত্তি থাকে না। নদী বেঁকে শুয়ে আছে এরকম দৃশ্য কেউ দেখে নাই। কোনোদিনও! তারপরে এক কবি বলেছেন, নদী বেঁকে শুয়ে আছে। আমরা পড়েছি আর চোখের ভেতর সর্‌সর্‌ করে ময়াল সাপের মতো নদীটা ঢুকে গেছে। মাথায় মগজে এঁকেবেঁকে শুয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে নদীর শরীর মোচড়ায়, আমাদের হৃদয়ে পড়ে টান। শরীর টান টান দুঃখে ভেঙে যায়– নদীর না, আমাদের।

নদীটি বেঁকে শুয়ে আছে, তাতে কারো আপত্তি নাই। নদীকে যেদিন তোমরা ক’জনে মিলে নদীর পাশে শুইয়ে দিলে এলোমেলো করে, সেদিন নদী আরো নিথর হয়েছে। কবি সেখানে ছিলেন না। কেউ ছিলো না (অথবা ছিলো)। তোমরা চলে গেলে, একে একে সকলে সেই আশ্চর্য দৃশ্যটি দেখেছে। নদীর পাশে নদীর বাঁকানো লা–ল টুকটুকে নগ্নশরীর। সবার খুব ভালো লেগেছে। সবার খুব খারাপ লেগেছে।

চিত্রগ্রাহক ছবি তুলেছে। ফুল এক্সপোজারে, দুটা ওয়াইড আর দুটা ক্লোজ শট।
সাংবাদিক রক্তপরিমাণ ও কাপড়পরিমাণ রেশিও করেছেন আঁক কষে।
কবি ছিলো কেবল নিশ্চুপ, সকলের শোরগোলে।

***
– ৫.১১.৯

দ্র. শুরুর লাইনগুলো এমনি এমনি লিখলাম। সিরিয়াস কিছু নয়! ;;;

১,৫৫৬ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “কবিতা-সিরিজঃ সে”

    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      শোভন, এই লাইনটার একটা অর্থ বা তাৎপর্য আছে। 'সে' একজন নারী (এইখানে, কল্পনায়)। তার চলাচল, তার বেঁচে থাকায় আশেপাশের পরিবেশ কেমনভাবে কাজ করে সেটা বোঝার চেষ্টা করো। নাকপথে কেবল বাতাসই ঢোকে, সাথে ধুলা আর ধোঁয়া। নাভিপথের সাথে সংযোগ কিসের? নাভিপথে তার শরীরের সাথে অপত্য আরেকটি জীবন জড়িয়ে থাকে। কিন্তু সেই নতুন জীবনের জন্ম কি খুব সরল? বা নির্মল? কতজন নারী অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জন্ম দেন, সেটা চিন্তা করো। তার নিজস্ব শরীরের ব্যাপারে তার নিজের অধিকার সবচেয়ে কম, এটা কতটা যন্ত্রণার!

      'কবিতা বুঝা' শুনে প্রশ্ন জাগলো, কোনো চিত্রকর্ম কি বুঝা লাগে? কোন নাচের দৃশ্য কি বুঝা লাগে? এটা তো যুক্তি সংক্রান্ত কিছু না যে বুঝা লাগবে। এখানে কিছু দৃশ্য আর তার ভিতরে কিছু কথা বলা আছে। তুমি নিজের মতো করে সেটা পড়লে, তোমার ভেতরে তা একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। সেটুকুই কবিতাপাঠের আনন্দ...

      জবাব দিন
  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)
    নদী বেঁকে শুয়ে আছে।
    নদীর বাঁকানো লা–ল টুকটুকে নগ্নশরীর। সবার খুব ভালো লেগেছে।

    আমারো খুব ভালো লাগছে! 😛


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  2. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    সবগুলা বড় ভাল লাগলরে।অনেকদিন কবিতা পড়া হচ্ছে না। কবিতা আয়েশ করে পড়তে হয়।
    তোর কবিতা সবসময় চিত্রকল্প নির্ভর বড় ভাল লাগে। বিশেষ করে ২ আর ৪ নম্বর এককথায় অসাধারণ।

    জবাব দিন
  3. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    এক আর তিন সবচেয়ে বেশি আ্যাবস্ট্রাক্ট মনে হলো । এক পড়তে গিয়ে আমার চোখে একটা মেয়ে অশরীরি ভেসে বেরাচ্ছে, এই দৃশ্য ভাসছিল । বলতে পারবনা কেন 🙁 দুই এর ব্যাখ্যা তো তুই নিজেই দিলি । আমার কাছে প্রথম পড়ে মনে হচ্ছিল কেউ খারাপ কিছু একটা করতে যাচ্ছে । তিন এ এসে আমি বেশ বিভ্রান্তিতে আছি । ছবিটা ধরতে পারছিনা । তবে ক্যাপিটালিস্ট জীবন, টাকার পিছনে ছুটে চলা, দুম করে মরে যাওয়া এগুলো মনে হলো । চার খুব ভাল লিখছিস । কিন্তু মনটাও খারাপ করে দিলি । এই বাংলাদেশে প্রতিদিন যে কত নদী এভাবে কষ্ট পায়, ক'টা আমরা পত্রিকায় দেখি । জা'নগরে একটা মেয়েকে মেরে ফেলেছিল কতগুলো পশু । মেরে ফেলেছিল বললএ অবশ্য কম হয়ে যায় । এত কষ্ট কোন মানুষের পক্ষে দেয়া সম্ভব, সামু'তে না পড়লে জানতাম না । খুব জানতে ইচ্ছা করছে জানোয়ার গুলোর একটারো কি শাস্তি হয়েছে ? চারিদিকে এত কষ্ট আর কিছু না করতে করতে কোনদিন যে বিবেকটা মরে যাবে । নাহ অনেক বিষন্ন করে দিলি । কিছু একটা করে বিষন্নতা কাটাতে হবে । কবিতা লিখে যা, আর এরকম বিষন্ন করে তোল আমাদের ।

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)
      আমার কাছে প্রথম পড়ে মনে হচ্ছিল কেউ খারাপ কিছু একটা করতে যাচ্ছে

      খারাপ কিছুই একটা বলতে পারেন। সেরকম ঘটনা তো চারপাশে কতোই দেখি, একজন নারীর অমতেই তাকে 'মা' হতে হয়। এটা অন্যায়, নৈতিকভাবে একজন মানুষের অধিকার-হরণের পর্যায়ে পড়ে আমার কাছে।

      কবিতা লিখে যা, আর এরকম বিষন্ন করে তোল আমাদের

      এমনিতেই আমি যা লিখি, আরো বিষণ্ণতা লিখলে সব কান্নাকাটি দিয়ে ভরে রাখতে হবে! তবে অনেক ধন্যবাদ বস। আসলেই অনেক ধন্যবাদ। :hatsoff:

      জবাব দিন
  4. রকিব (০১-০৭)

    কবিতা সিরিজের শুরুটা পছন্দ হয়েছে। শুরুর কথাগুলোও দারুণ, সত্যিই অদ্ভুত সুন্দর।
    এবারে একটা প্রশ্ন। কবি যখন কবিতা লেখেন তখন অবশ্য তিনি যে ভাবে চিত্রকল্প কল্পনা করেন, পাঠকগণ প্রায়শঃই কবির চিত্রপটে না ভেবে নিজের মতো রাঙ্গিয়ে নেয়। অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো মূল ভাবটাই প্রায় পূর্ণ-রূপান্তর লাভ করে। এই যে আপন মানসপটে মাঝে মাঝে সামান্য ভিন্ন ভঙ্গিমায় কবিতা বুঝে নেয়ার যে ব্যাপারটা এসম্পর্কে আপনার কি অভিমত?


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      সামান্য ভিন্ন কেন, সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে যদি কোনো কবিতা অনুধাবিত হয় সেটা কবির জন্যে বিশেষ পাওয়া। কবিতায় সবসময়েই পাঠকের রিলেট করার একটা জায়গা ফাঁকা রাখা থাকে। গল্প/উপন্যাসের চেয়ে এখানেই কবিতার পার্থক্য যে নির্দিষ্ট কোনো ফ্রেম, চরিত্র বা ঘটনা এখানে সরাসরি বর্ণনা করা হবে না। (এতে করে সমস্যা যা ঘটে তা হলো কবিতা অনেক সময়েই রহস্যময় আচরণ করে)

      তবে পাঠকের এই স্বাধীনতাকে আমি পূর্ণ সমর্থন আর সাধুবাদ জানাই। এই কারণেই আমি কখনই সরাসরি নিজের লেখক হিসেবে ভাবনাগুলোকে প্রকাশ করতে চাই না। আমার লেখক হিসেবে সবকিছু সরাসরি বলে দেয়া মানেই পাঠকের কল্পনার জানালায় একটা খিল এঁটে দেয়া। এটা হয়তো পাঠকের পরিশ্রম কমিয়ে দিবে বা অযথা ভুল বোঝা, রহস্যময়তার অবসান ঘটাবে, তবে আদতে তা কবিতার জন্যে ক্ষতিকারক। কবিতার যে ব্যাপ্তি সেটা লেখকের মনোভাব (শানে নুযূল) জানামাত্রই তার নিজস্ব বৈচিত্র্য হারায়।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আন্দালিব (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।