গল্পঃ স্মৃতিভ্রষ্টতার উল্টোযাত্রা

এটাই প্রারম্ভের অন্ত অথবা অন্তিমের আরম্ভঃ এরকম ঘোষণায় সচকিত হয় রোমকূপ। সামনে জীবন নাই, আশা নাই, সুর নাই, নারী নাই। নেশা নাই, কবিতা নাই, তোমার দুচোখ নাই। তার থেকেও তীব্রশরীর, স্তন আর নাভিমূল নাই, তোমার মধুকূপী বাহু নাই, রীডসুলভ আঙুল নাই। প্রথাগত শূন্যতার চাইতেও বেশি কিছু, অনেক কিছু জীবন ছাড়িয়ে যার ছায়া পড়তে পারে, আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। সংখ্যারেখার প্রমাণবিন্দু হারিয়ে গেলে খুব বিপন্ন লাগে। যেমন বিপন্ন লাগে সময়-ঘড়ি হারালে। যেমন বিপন্ন লাগে মাংস স্বাদের গন্ধ হারালে।

আরম্ভ হলেই শেষ হবে, জানা কথা। তাহলে কোন কিছু শুরু করতে আমি এতো উদযাপন করি কেন? উদ্বোধনের প্রগলভ উচ্ছ্বাসে আমি সময় অপচয় করি, অর্থ আর শ্রম ব্যয় করি, যদিও জানি সামনে এরকম কিছু নাই- কিছু থাকবে না। এই ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার মতো অমোঘ নিয়তিতে সব প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে আর আমার খেলার মাঠ জুড়ে বিষন্ন কাক বসে র’বে।

চিকন কণ্ঠে তুমি গাইছো। একটু কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে গলা। ওটা পেরিয়ে যাই আমি, ও কিছু না। গানটা সুন্দর লাগছে, কান দিয়ে ঢুকে বুকে পৌঁছে যাচ্ছে। আপাত নির্বাক আমি একটু আগে বলছিলাম, একটা গান শোনাও না। তুমি লাজুক হাসছিলে, ধুর! আমি গান পারি নাকি? আমি বললাম, খুব পারো। গাও, আমি শুনবো। তুমি শুরু করতেই আমি জড় হই, স্থির হই। কাঁপনগুলো থেমে আসে। বোধসমূহ তাবৎ জামাকাপড় সাজসজ্জা খুলে ঘুমুতে যায় আলো নিভিয়ে।

অনেকক্ষণ পরে, কখন আমার খেয়াল নেই, তোমার গান হয়তো অনেক আগেই থেমে গেছে। গান থামিয়ে তুমি আমাকেই দেখছিলে হয়তো। আমি সম্বিত ফিরে পাওয়ায়, সেটা হারানোর লজ্জায় বিব্রত হই। ভালোবাসা প্রকাশিত হলে লাজুক লাগে মনে হয়! আমি শশব্যস্ত হয়ে ঘুঘু পাখির ডাক শুনতে চেষ্টা করি। কী আশ্চর্য! এই নিশুতিতে ঘুঘু কোত্থেকে আসবে? “ঘুঊঊঊ …ঘুঊঊঊ …” আমি চমকে তাল সামলে বুঝতে পারি কোথাও আসলেই ঘুঘু ডাকছে। গভীর বিষন্ন সুরে ডাকছে। সেই ডাকের পশ্চাতে একটা বিমর্ষ হাহাকার জেগে উঠতে থাকে। দূরত্ব বাড়লে আমাদের প্রিয় মুখের উত্তাপ কি ধীরে ধীরে কমতে থাকে? আমরা কি স্মৃতি প্রখর নই? কেনইবা আমাদের প্রতিদিন দেখা লাগে, ছোঁয়া লাগে, খুঁজে নেয়া লাগে প্রাণান্ত-আত্মাদের!

গায়ের গন্ধ খুব মাতাল করে দিতে পারে। নাসা ফুলিয়ে ফুলিয়ে আমি যে সুবাস পাই তা নিউরণে ঢুকে কী প্রলাপ শুরু করে দিতেছে, আমার স্রোতবহা রক্তে নাচন ধরিয়ে দিচ্ছে! সেখানে কণিকার ভাঁজে ভাঁজে রূপায়িত ঘুঙুর বেঁধে ঝুন ঝুন, রুন ঝুন করে তোমার ত্বক-সৌরভ ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি গাঢ় হয়ে আসি, ঘন আর নিবিড় করে তোমাকে জড়িয়ে ধরি। তাপ পরিবাহে আটানব্বুই ডিগ্রীর তীব্রতার আঁচে আমরা জড়লাল হয়ে উঠি! দূরত্ব কমে গেলে তোমার বুকের ভাঁজে একটা নরম তিল জন্মে আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি দূরে যেতে চাই না। আমি চোখের আড়ালে যেতে চাই না। ইন্দ্রিয়-বিপন্ন হয়ে আমি খুঁড়ে খুঁড়ে গোপন বিষন্নতাগুলো লুকিয়ে রাখতে চাই।

তুমি সেকথা জানো। খুব ভালো করেই জানো বলেই হেসে দাও খিল খিল করে। চুলের শীর্ষমুখী কাঁপন থেকে থরে থরে মুক্তার মতো হাসি ঝরে পড়তে থাকে। আমি তোমার সাথে নিবিড় হয়েও বিস্তারী-অস্থিরতা লুকাতে পারি না।

-“মাত্র তো একটা সপ্তাহ!”
-“মাত্র?”
-“আহা! তুমি অবুঝ হলে আমি কোথায় যাই?”
-“কোথাও যাওয়া লাগবে না। থাকো।”
-“আমার দায় তুমি বুঝো না? দিনগুলোকে কঠিন করে দিও না।”
-“কেন নয়? আমি কীভাবে থাকবো অনুভব করো তুমি!”
-“করছি বলেই, করবো বলেই তো ফিরে আসবো!”
-“কবে?”
-“এই তো, সাত দিন। কষ্টে কাটবে দিনগুলো!”

আমি ম্রিয়মাণ ক্ষোভে সরে যেতে থাকি দূরবর্তী বাতিঘরের মতো। ছলাৎ শব্দে পাড়ভাঙা বিষাদ এলোমেলো বয়ে যেতে থাকে তথৈবচ উদ্দেশ্যহীন। শরীর শীতার্ত আগ্রহে স্বেদকণা শুকিয়ে নোনাদাগ ধরে রাখে। আজ মনে হয় তিন দিন-তিন রাত হলো, আমি দেখি নাই তোমাকে। অবসর মুহূর্তের ক্লান্তি জ্যাকেটের বোতামে লেগে থাকে। যেমন অনেক সময় বাতি নেভানোর পরেও আলোর রেশ চোখে লেগে থাকে। বাইরে কুয়াশা ছিটকে দেউড়ি পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। আবছায়া আলোতে দেখি ছেঁড়া পৃষ্ঠার মতো হালকা দোলনে শিশিরকণারা দুধসাদা বিছানায় শুয়ে পড়ছে। আমি ধীরপায়ে তাদের সরিয়ে গুটিসুঁটি মেরে শুয়ে থাকি জামাকাপড় না ছেড়েই। গ্রাফাইট কণার গন্ধ জড়িয়ে থাকে লিনেনের প্রান্তে। ঘুম এসে ভেঙে ভেঙে যায় এই বিভ্রমে যে আমি চলন্ত ট্রেনে আছি, যেটাতে করে রোজ ফিরি। আমার উল্টোদিকে ব’সে থাকা ভাবলেশহীন মুখব্যক্তি চোখ মেলে দেখেই আমি চমকে উঠি। লোহার হাতলের স্পর্শও আমাকে শিহরিত করে। ট্রেনেই আছি তাহলে! শাটলের মতো দ্রুততায় তুমি সরে সরে যাও। আমি দুঃস্বপ্নের ছোবল ভেঙে জেগে উঠি। গলা শুকিয়ে কাঠ! অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে সিঙ্ক পর্যন্ত গিয়ে পানি খাই ঢকঢক করে। রেখে দেয়ার সময়ে গ্লাস বড়ো শব্দ করে টাইল্‌সে!

আমার মনে হচ্ছে তোমাকে আর কখনোই দেখা হবে না আমার। যেদিন শেষ দেখেছি সেটাই তোমার আমার শেষ দেখা ছিল। ফ্ল্যাশের আলোতে চোখ ঝলসে গেলে তারাবাজি হচ্ছিল চোখে, ফুটি ফুটি তারা জ্বলে নিভে উঠছিল। সয়ে নিতে নিতে তুমি হেসে নির্বাক ফটোফ্রেম হয়ে গেলে। দ্বিমাত্রিক তলের নিষ্ঠুরতায় তাকিয়ে আছো! ঈষৎ হেলানো তোমার মাথা। চুলগুলোও ঢেউ খেলিয়ে সরে আছে। ঠোঁটে একটা হালকা হাসি ধরে আছো। আর চোখের তারায় দুষ্টুমি। আমি ক্যামেরার ফ্ল্যাশের সাথে বিন্দু বিন্দু তোমাকে বেঁধে নিয়েছিলাম।

পীতাভ ঝলকে তুমি আটকে আছো তেইশে। তেইশ পেরিয়ে আমি অনেকদূর চলে গেছি। দূরত্ব বাড়লেও টান কমে না কেন? নাকি কমে যায়? জ্যামিতি ভালো বুঝি না বলে ক্লাশের স্যারেরা খুব বকতো। মারও খেয়েছি কম না। তারপরেও আমি কিছুতেই দুই বিন্দুর দূরত্ব বের করতে পারতাম না। বারবার ভুল হয়ে যেত। আরও কতো কতো ভুল হয় আমার! হিসেবে ভুল, সময়ে ভুল, স্মৃতিতে ভুল। এখানে জলজ চোখ ছেড়ে তুমি শুষ্ক হয়ে গেছো- জানার পরেও আমি প্রক্রিয়াজাত করতে পারি না। ক্রমশই আমার মনে হতে থাকে,”এই তো, সাত দিন। কষ্টে কাটবে দিনগুলো।” বলে তুমি উঠে গেছো। তোমার শরীরগন্ধী উষ্ণতা এখনও পড়ে আছে এখানে কয়েকবিন্দু। আমি দু’হাতে সেগুলো কুড়িয়ে মুঠোবন্ধ করতে থাকি। করতলে তখনও ঘুঘুর ধুকপুকানি শোনা যায়!

(সমাপ্ত)
——
নভেম্বর, ‘০৮

৩,৩৭৪ বার দেখা হয়েছে

৩৯ টি মন্তব্য : “গল্পঃ স্মৃতিভ্রষ্টতার উল্টোযাত্রা”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    পীতাভ ঝলকে তুমি আটকে আছো তেইশে।

    বুঝলাম না, নায়িকা কি মইরা গেছে। তাইলে সাত দিনের ব্যাপারটা কি? আবার ট্রেনের কথা কইলা। নায়ক কি কোথাও যাইতেছে।

    আউলা বাউলা লাগতেছে। সারমর্ম কও তো


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. ঐ মিয়া কৈশোরের মতো কিছু লিখো তো।

    এইটা পইড়া ব্রেনের চাক্কা জ্যাম চইয়া গেছে। প্রথম দিকে তো ঠিকই ছিলো , সব বুঝতেছিলাম। কিন্তু শেষের দুই প্যারায় আইসা পুরা প্যাচ লাগাইয়া ফেলাইছি। তুমি না বইলা দিলে বুঝতামই না যে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেছে নায়কের।
    তবে কবিতার মতো হইছে অনেকটা। শব্দগুলি সুন্দর। :thumbup:

    জবাব দিন
  3. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    প্যারা তো প্যারা, প্রতি লাইনে লাইনে অর্থ ধরি ধরি করেও কেমনে যেন হাত ফস্কে বেরিয়ে গেল।

    আমার জন্য কামরুলের কথাই দেখলাম সবচেয়ে ভালো খাটে।

    আরও বড় কথা যেইটা সেইটা হইলো বৌটারে মিস করতেছি 🙁 :(( 🙁 :(( ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  4. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    পুরা পোস্টটাই কোট করে ফেলতে ইচ্ছা করতেসে...কোনটা রাইখা কোনটার কথা বলব...আপাতত সানা ভাইয়ের কমেন্টটাই চোথা মাইরা দেই...

    আন্দালিব, উত্তর আধুনিক কমলকুমার মজুমদার।


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  5. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    @আন্দালিব,

    যদিও খুব স্থূল প্রকাশ হয়ে গেলো, তবুও কম্পলিমেন্ট হিসেবে নিলে ভালো লাগবে...

    "পুলা তো নয়, একখান আগুনেরি গুলা রে!" :hatsoff:


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  6. তাপ পরিবাহে আটানব্বুই ডিগ্রীর তীব্রতার আঁচে আমরা জড়লাল হয়ে উঠি! দূরত্ব কমে গেলে তোমার বুকের ভাঁজে একটা নরম তিল জন্মে আমার দিকে চেয়ে থাকে।

    :clap: :clap: 😉

    জবাব দিন
  7. ভাই, আপনার এই লেখাটা এক্কেবারে হৃদয় ছোঁয়া।

    পীতাভ ঝলকে তুমি আটকে আছো তেইশে। তেইশ পেরিয়ে আমি অনেকদূর চলে গেছি। দূরত্ব বাড়লেও টান কমে না কেন? নাকি কমে যায়?

    এই লাইনগুলো বারবার মাথায় ঘুরছে। ভাই আপনে এত বস কেন?

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।