এই শহরে আমার পথে মগ্ন হয়ে যায় বাসের শিস

এই যে ঢাকা শহরে হেঁটে চলে বেড়াই, দিন যায়, মাস যায়, গরমের দিনগুলো পেরিয়ে শীতের বাতাস আসে। তারও আগে বৃষ্টি ঝুম করে দারুন ভিজিয়ে যায়। সিক্ত নগরীও একসময় শুকিয়ে ওঠে। তারপরে আবার কুয়াশা কেটে চরাচরে উৎসব জমে ওঠে। এরকম দিনাতিপাতে খেয়াল থাকে না কখন বেড়ে উঠছি। বয়েসের কোঠা একটা একটা ধাপ পেরুচ্ছে। সেখানে ধাপে ধাপে কতমুখঃ চেনা-অচেনা-সাদা-তামাটে-কালো-কালিমাখা। এইসব মুখের ভীড়েও কাউকে চিনে ফেলি স্বজন মনে করে। কাউকে দু’চোখে ঘৃণা করি শত্রু ভেবে। এভাবেই দিন কাটাই। ঘুড়িওড়া দিন শেষে টের পাই, বয়েস বাড়ছে। যেসব সময় পিছনে ফেলে এসেছি সেসব কেমন বিবর্ণ হয়েও জ্বলজ্বল করছে। ফিরে তাকালে হাসিমাখা কিংবা কান্নাভেজা দু’ চোখ দেখি। পুরোনো আমি’র সেই দু’চোখ আমাকে মাঝে মাঝে সাহস দেয়ঃ “এই দেখো, পুরোনো আমাকে ফেলে তুমি কতো কতো পথ এগিয়ে গেছো! সেখানে তোমার ত্বকে ভাঁজের সাথে জমেছে স্মৃতিরা।” আবার মাঝে মাঝে সেইমুখটাই আমার দিকে তাকিয়ে ঠা ঠা হেসে দেয়ঃ “কী অদ্ভুতভাবে তুমি ব্যর্থ হচ্ছো! এতকিছু শিখেও বুঝে উঠলে না জীবনের মানে!”

শহরের কথা বলছিলাম। কিছু কিছু রাস্তা এখানে আমার হাতের তালুর মতো আপন মনে হয়। এমনও হয়েছে, দিনে দু’তিনবার করে একই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেছি। আজকে যেমন ফিরে আসছিলাম, সোজা শাহবাগ থেকে ক্যান্টনমেন্ট। রাত ঘড়িতে নয় ছুঁই ছুঁই। রেডিয়াম জানিয়ে দেয় খুব বেশি বাকি নেই, নিশুতি রাত নেমে আসবে এই জরাক্লান্ত শহরটাতে। রাস্তার আলোগুলো আরও ম্লান হবে আর ঢাউস পেতনি-র মতো সিটিবাসগুলো ভাঙাচোরা বাম্পার আর চটে-থেবড়ে যাওয়া বডি নিয়ে নিঃশব্দ হবে। আমি মোড় থেকে একটা মিশুক নেই। সিএনজি পেলাম না। ওরা আসার পরে এই মিশুক কেমন জানি দত্তক-নেয়া সন্তানের মতো হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকলেও কাছে ডাকি না। সিএনজি-কে খুঁজি। এখন যেমন, না পেয়ে অগত্যা! উঠে পড়ে টের পেলাম কী অবহেলায় মিশুকটা দিনে দিনে পাশের বারডেমের বহুমূত্র রোগীর মতো শুকিয়ে ছিবড়ে হয়ে গেছে। গিয়ার বদলাতে গেলে অদ্ভুত ঝাঁকুনি দেয়। পিঠের পেছনে ফোমটাও চিমশে গেছে বলে আমাকে শিরদাঁড়া সোজা করে রাখতে হয়। বাস্তবতার কঠোর চাপে ওটা প্রায় বেঁকে গেছে বলে এখন সোজা করতে অস্বস্তি হয়, টের পাই।

চারপাশে ডাইনিগুলো খেদিয়ে আমাদের ড্রেনের কাছে নিয়ে যায়। দীর্ঘ বন্ধ্যাকালীন জ্যামে বসে বসে আমি ফুটপাতের দ্রুতগামী মানুষ দেখি। কাজ শেষে সবাই ফিরছে। কতো কতো দূর এরা এভাবেই হেঁটে যাবে। আমিও মাঝে মাঝে যেতাম, যেতে হতো- যখন কিছুই পেতাম না রাত বেড়ে গেলে, তখন পায়ের জোর বেড়ে যেতো কোন কারণে। একটু পরে, বেশ একটু পরে আমরা দাড়িয়ে থাকাদের ফাঁকফোঁকর গলিয়ে দাহ্য-গ্যাসোলিনের ইঞ্জিনের পাশে এসে যাই। সিগন্যাল ছাড়ে অনেকক্ষণ পরে। ওপাশে অসহায় বন্ধ্যাদের ফেলে আমার মিশুক আবার গুঙিয়ে এগুতে থাকে।

বাতাসটা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সামনে শীতে অনেকগুলো মানুষ মারা যাবে। পেপারে লিড হবে সেটা। তারপরে পেছনের পাতায় যাবে, সেখান থেকে ভিতরে ময়লাটে পাতায় স্থান পাবে কারণ আর কোন খবর নেই এই দেশে। শীতে কুঁকড়ে মানুষস্বরূপ প্রাণীদলের মরে যাওয়াতে পেপারকাটতি, মানবাধিকার-সংগ্রামীদের উদ্যোগ এসবই সার। এরপরে আর কিছুনাই- এটাই বড়ো সত্য! তারপরে বসন্ত এসে গেলে আমরা অপরাধবোধের জোয়াল নামিয়ে রেখে হাঁপ ছাড়বো।

এখন আমার মিশুক বেগবান! এঁকেবেঁকে ছুটছে, যদিও বৈমাত্রেয় সিএনজি টপকে যায়, কুৎসিত প্রতিবেশী কালো কিংবা হলুদ ট্যাক্সি টপকে যায়। রাস্তার মাঝখানে কয়েকটা ম্যানহোল, ওগুলোর চারপাশে একটা সিমেন্টের বর্ডার দেয়া। আমার মিশুক ওগুলো টপকে যাবার সময়ে জোরে ঝাঁকুনি খায়। মসৃণ ত্বকের ওপরে জড়ুল!! আমি সামনের জংধরা রডটা শক্ত করে ধরে থাকি। পথে সার্ক ফোয়ারার বিষন্ন গোলক দেখি। গোলকের গায়ে হেডলাইট-টেললাইট-স্ট্রিটলাইট পড়ে পড়ে কী মোহময় ছবি আঁকছে। এই শহরেও সুন্দর জন্ম নেয় তাহলে! চুপচাপ দু’সেকেন্ড বেঁচে থাকে। তারপরে কর্কশ হর্ন-ধোঁয়া-ধুলোয় ওদের মৃত্যু হয়। আমি ঐ জীবন্ত সৌন্দর্যের জীবনকাল দেখি, কিন্তু শেষকৃত্যে সঙ্গী হতে পারি না।

বিজয় সরণি পেরিয়ে নাখালপাড়ার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাই। এখানে রাস্তা ফাঁকা-প্রায়। ঠাণ্ডাটা গায়ে লাগছে এখন। আরো কয়েকটা জড়ুল পড়ে পথে। মিশুকওলা একটু আগে র‌্যাঙগস-ভবনের সামনে তার হাতের কড়াপরা তালু দেখাচ্ছিলো। সারাদিন খ্যাপ মেরে, গরমে রাবারের হাতল মসৃণ করে ফেলেছে, সেখানে তার হাতও কালশিটে পড়ে মসৃণতর হয়ে গেছে। দেখে আমার ত্বকেও চর পড়ে যায়!! তোবড়ানো গালের লোকটা অনেক বেশি ভাড়া চেয়েছে, নিরুপায় হয়েই উঠেছি। তবে সেসব কিছু ছাপিয়ে ওঠে অন্যকিছু। আমার খুব তাঁর কাঁধে হাত রাখতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। রডের পাশেই তো! তার আগেই সিগন্যাল ছেড়ে দিলো। আবার ঝাঁকুনিতে সামলে বা বেসামলে নিই আমি।

ঢোকার মুখে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাবেন? উত্তর দেই স্বাভাবিকভাবে। এই পাহারা, কড়াকড়িতে সন্ত্রস্ত হয়ে যাই, অপরাধী লাগে আর হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো সংকুচিত হতে থাকি। বাসার কাছাকাছি এসে ডিরেকশন দেই। মিশুক থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাসায় পৌঁছে গেলে টের পাই গত একঘন্টায় শরীরে কয়েক পরত ধুলো আর ময়লা জমেছে। আমার শহরের ধুলো। চকিতে শহবাগ থেকে বাসা অবধি পথ মনে ভেসে ওঠে! ডাইনি বাসকে বৃদ্ধ-পিতামহের মতো মনে হয়। অনাত্মীয় ট্যাক্সি কিংবা প্রিমিও গাড়ীগুলোকেও অতো বেশি পর মনে হয় না! শিরদাঁড়া সোজা করে রাখতে রাখতে এখন বেশ আরামও পাই। তখনই টের পাই এই শহরটা আমাকে কীভাবে মায়ায় বেঁধে ফেলছে। শিকড়ের সন্ধান জানি না, তবে আমি পিচমেশানো শহরের মাটিবিহীন জমিনে নিজের কিছু ত্বকছায়া পড়ে থাকতে দেখি।
—-
৪ঠা নভেম্বর, ২০০৮

২,০৯৭ বার দেখা হয়েছে

২০ টি মন্তব্য : “এই শহরে আমার পথে মগ্ন হয়ে যায় বাসের শিস”

  1. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    অনেকগুলো লাইন উদ্ধৃতি আকারে দিই দিই করেও দিলাম না। কারণ তাতে পুরো লেখাটাই চলে আসবে বলে ভয় হচ্ছিল। হাজারবার পেরিয়ে আসা শাহবাগ থেকে ক্যান্টনমেন্ট আসার রাস্তাটা কখনো এভাবে ফিল করিনি।

    সাবাস আন্দালিব :clap: :clap: ।
    অতুলনীয় প্রকাশ তোমার।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  2. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    ভাইরে অসাধারন হইছে 🙂 🙂 🙂


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  3. তাইফুর (৯২-৯৮)

    আন্দালিবের অসাধারণ লেখা, ব্যাকগ্রাউন্ডে 'চন্দ্রবিন্দূ'র গান।
    অসাধারণ, অসাধারণ।
    (আন্দালিবকে লিখার জন্য, কামরুলকে গানের জন্য ...)


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  4. আন্দালিব (৯৬-০২)

    মুসতাকীম, ফয়েজ ভাই, হাসনাইন ভাই,ফৌজিয়ান, তাইফুর ভাই, রবিন ভাই, তানভীর ভাই, সকলকে অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি আসলে নিজের আনন্দটা প্রকাশ করার ভাষা পাচ্ছি না। এখানে আমি একেবারেই নতুন, সেজন্যে সবার সাথে এখনও পরিচয় গড়ে ওঠেনি। এমনকি সবার লেখাও পড়া হয়নি সেভাবে। তারপরেও আমার মতো নতুন কাউকে আপনারা যেভাবে প্রশংসা আর অভিনন্দন দিচ্ছেন তাতে খুবই ভালো লাগছে। ধন্যবাদ আবারও ... সবাইকে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।