জুনের চারঃ পিরিচের ওপর উনপঞ্চাশটি পানিবিন্দু

[গত পরশু রাতে ব্লগে লগ-ইন করলাম এই লেখাটি পোস্ট করার জন্য। তারপরেই দেখলাম তুহিনের ছুরিকাহত হওয়ার সংবাদ নিয়ে পোস্টটা। আমি দুঃখ বিপদ আপদ ঠিক সামাল দিতে পারি না। তারপর থেকে খালি বার বার পোস্টটা রিফ্রেশ দিয়েছি। একটু আগে দেখলাম ভালো সংবাদটা। এই সময়ে বারবারই মনে পড়ছিল দুইটা গেট-টুগেদারে দেখা হাসিখুশি ছেলেটার চেহারা। তাই এই লেখাটা তুহিনের জন্য, সাথে যারা গত দিনদুই ওর পাশে থেকেছে সর্বাত্মকভাবে তাদের জন্যেও!]

ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ

ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ


ঠিক জন্মের মুহূর্তে, আমাদের স্মৃতিতে সম্ভবত কোন তথ্য জমা পড়েনি। পড়লেও, সেই তথ্য, ছবি বা শব্দ উদ্ধারের ক্ষমতা আপাত-সাধারণ মানুষের নেই বললেই চলে। আমার কেন জানি মনে হয় স্মৃতিধর মানুষের জীবনের এটা একটা করুণ পরিহাস, সে নিজের সৃষ্টির মুহূর্তের কোন স্মৃতির সাক্ষী হতে পারে না। সেইসময়কে মনে করে কী অপার্থিব অনুভব হতে পারে, সেটা আমাদের কারোই জানা নেই। এগুলো নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি, এবং খুব অদ্ভুতভাবেই আমি এমন একটা মুহূর্তের অধিকারী। এমন একটা সময়, যার পর থেকে আমার বাকি জীবনের সবকিছুই বদলে গেছে। বলা চলে একটা নতুন জন্ম, একটা দ্বিতীয় জন্ম; নব উন্মোচন ঘটেছে আমার জীবনেই। আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই সময়টিতে তার গুরুত্ব বুঝে উঠতে আমি একেবারেই পারিনি। এখন তেরো বছর পিছনে তাকালে, ক্রমশ আমার কাছে এটাও পরিষ্কার হয় যে আমাদের জীবনে ঘটমান চমকের স্বরূপ বুঝতেও আমাদের অনেকদিন লেগে যায়।

চৌঠা জুনের বিকেলে, ঈষত ঢালু পিচের রাস্তা দিয়ে গাড়িটা যখন গেইট পেরিয়ে ঢুকছিল, গাড়ির কাচের উপর দিয়ে সারবাঁধা পাতাবাহারের রেলিং আমার চোখে পড়ে, এখনও। আর একটু এগুলেই সবুজ। সবুজ আঁধারের মত ঘন নরোম মাঠ। চোখের ভিতরে সেই সবুজ আগুন ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে খুব অজান্তেই। আমি টের পাই যে এখানে বিস্তৃত মাঠের পাশে আমি কতটা ক্ষুদ্র, অপাংক্তেয়। এর পরের ছয়বছরে যতবারই গেইটটা পেরিয়ে ঢুকেছি, আমার ঘাড় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ডানদিকে ঘুরে গেছে। কী সবুজ! মায়াময়, তীব্র আকর্ষণ! কুহকের মতো টানে। আজকে সেই সবুজ মাঠটাকে এড়িয়ে বাকি সময়ের দিকে চোখ মেললে কেবলই ঘোলাজল, কেবলই ঘূর্ণন। এক একটা দিনের গল্প, এক একটা মুহূর্তের কথাতেই কত গল্প মিশে গ্যাছে। সেই গল্পে হাসি, কান্না, দুঃখ, সুখ, রাগ, বিরক্তি, বিষাদ, একাকীত্ব আর সৌহার্দ্য কীভাবে গুলে গ্যাছে বেমালুম। আজ কোন চেহারাই সেখানে আলাদা করতে পারি না। একটা সুতোকে খুলে আনতে গেলে, সাথে জড়াপাকানো সুতোরাই বাকবাকুম কথা বলে ওঠে!

ঘোলাজলেই মুখ ভাসায় গোঁফওয়ালা মকবুল ভাই, আমাদের গেমসের ঠিক আগে, তিনি একটা কাঠের ট্রলি ঠেলে ঠেলে বাস্কেটবল, ফুটবল, ভলিবলগুলো নিয়ে আসতেন। মাঝবয়েসী, তখন যাকে প্রাগৈতিহাসিক মনে হত আমাদের, ঈষত ঢুলুচোখের মকবুল ভাই ট্রলিটা মাঠে আনলেই, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তাম। এই হুড়োহুড়ি তার স্থৈর্যধ্যানে ব্যাঘাত ঘটাত, তাই হয়তো একটা চাপা ‘গ্রান্ট’ করতেন। বিরক্তির কী অনাবিল বহুমুখী প্রকাশ! আমরা পাত্তা দিতাম কই? আরো মুখ ভেসে ওঠে কার- একটা হলুদ খামের। আমার নামেই এসেছিল, বেনামি খাম। স্যারের শ্যেন চোখে আটকে গিয়ে সেটা দুইবছর আটকে ছিল অফিসের টেবিল কাচের নিচে, টেবিল ক্লথেরও নিচে। আড়ালে, গোপনে, বয়ঃসন্ধিমাখা একটা ছেলের কবিতায় মুগ্ধ হয়ে কে যেন লিখেছিল। প্রেরিকার নামও পুরুষালি, যদি ধরা পড়ে যায় সেই ভয়ে! ধরা পড়েছিল ঠিকই, দুই বছর পরে সেই হলুদ বিবর্ণ হয়ে গেলে চিঠিটা আমার হাতে আসে। ততদিনে সেই কবিতা ছেড়ে গেছে, হলুদ খামের সাথে ফিকে হয়ে গেছে কিশোরীর স্মৃতি।

চৌঠা জুনে কেন এই মুখগুলো আকারহীন হয়ে আমার কাছেই ফিরে আসে?

এবারে চৌঠা জুনে, পঁচিশ-পেরুনো-আমি নতুন একটা সত্য আবিষ্কার করলাম। বিকেল গড়িয়ে গেলে আমিও সেই শৈশব-ছাড়ানো ছেলেটাকে খুঁজেছি, সেই অনুসন্ধান কত ব্যাকুল, কত উদগ্র, সেটা কে-ইবা বুঝবে? সেই টানেই দেখা হলো পুরনো সাথীদের সাথে। সবুজ মাঠের পাশে যাদের বিদায় জানিয়েছিলাম সাত বছর আগে, তাদেরই কেউ কেউ সাতবছরের গল্প নিয়ে ফিরে এলো আমার কাছে। এত এত কথা কি একরাতে বলে ফেলা যায়? জীবনের পথ বেঁকে কত দূরে নিয়ে যায় আমাদের! আমার মতোই পঁচিশ পেরুনো একজনের সাথেই এমন দেখা হলো, এখন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সাগরে সাগরে ঘুরে বেড়ায়। এই মানুষটাকে আমার নতুন জনপদের মতোই অজানা লাগে। যাকে চিনতাম, সে খুব অবলীলায় ঘুমাতো, দুপুরের খাবারে সব্জি দেখলে যার মুখ বাঁকা হতো, ছোটবেলায় খেতে পারতো না সে। একটু ঝুঁকে হাঁটা সেই সেলিম আজকে হেসে হাত বাড়িয়ে দিলে আমি অবাক হই, নির্বাক খুশিতে আমার ভেতরে গমগম করতে থাকে!

সাতানব্বুইয়ে চলে গিয়েছিল ফয়েজ। বাইরেই পড়েছে সে বাকিটা সময়ে। গত বারোবছরে যার সাথে দেখা হয়নি, চৌঠা জুনে দেখা হলো! তাও সেসময়ে কারেন্ট চলে গেছে। ফয়েজের গলার স্বরে আমি তাকে চিনি নাই, এমনকি সে অনেকক্ষণ অচেনা হয়ে রইলো কারেন্ট আসার পরেও। সেই চৌদ্দ বছরের কিশোর কোথায়? বাকিদের সাথে কথা, স্মৃতির দৌড়ে আমরা একে অপরের সাথে আজ হঠাতই মেতে উঠলাম! কত কত গল্প। সেই তোড়ে ভেসে এল কালো কুচকুচে আমীরুল স্যার। আমাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে যিনি নিখাঁদ স্বর্ণই বানিয়ে দিয়েছেন। ঘাই মেরে জেগে উঠলেন শীলা ম্যাডাম, আঠারো বছরে আমরা বিভ্রান্ত দুপুরে যার শাদা শাড়ির লাল পাড়ে আজও মুগ্ধ হয়ে আছি!

গল্পে গল্পে রাত বাড়লো। কয়েকজন বিবাহিত, কয়েকজন বিবাহোন্মুখ। অনুপস্থিত একজন ফুটফুটে মেয়ের বাপ, সেটাতেই বলিহারি গেল সকলে! পুরনো কিশোর-তরুণের খোলস ছেড়ে আমাদের প্রাকৃত জীবনে ফেরার সময় এসে গেল। আমি তখনও চুপচাপ হাতড়াচ্ছি। স্মৃতি এক হতচ্ছাড়া পিঁপড়ের মতো কুটকুট করে কামড়েই যাচ্ছে। হাত মিলিয়ে কথা শুরু হয়েছিল, ফেরার সময়ে বিদায়ে গলা মিলাতে দ্বিধাই হলো না! আবার কবে দেখা হয়, কে জানে? একজন আসেনি, শুনলাম সে সেই সবুজ মাঠের কাছেই চলে গেছে গতকালই। আমরা শুনেই আফসোস করি। ঢাকার জীবন আমাদের শেকল পরিয়ে দিয়েছে, নাহলে আমরাও সেখানে থাকতাম আজকে। বলার পরেও, আমরা জানি, আসলে থাকতাম না। সেই কিশোর জীবনের মাঠটাকে আমরা ওখানেই ফেলে এসেছি। এখন ফিরে গেলে কেবল শুকনো পাতার সাথেই দেখা হবে।

এই যে পরের চৌঠা জুনে অনেকে পৃথিবীর কোণে কোণে ছিটকে পড়বে পড়াশোনা, চাকরি বাকরির টানে। নিজেকে আমার পিরিচের উপরে পানিবিন্দুর মতো মনে হয়, প্রবল ঘূর্ণনে টাল সামলাতেই পারছি না। এই মুখগুলো অপরাপর বাস্তবতায়, নাকি চোখের অহেতুক বাষ্পে, নাকি গরমের ঘামে ঝাপসা হয়ে যায়। শুধু সেই সবুজ মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উনপঞ্চাশটা কিশোরের হাসিমুখ জ্বলজ্বল করতে থাকে!

***
৪/৬/৯

৩৩ টি মন্তব্য : “জুনের চারঃ পিরিচের ওপর উনপঞ্চাশটি পানিবিন্দু”

  1. তানভীর (৯৪-০০)

    লেখাটা পড়েই বলতে চেয়েছিলাম যে অসাধারণ একটা স্মৃতিচারণ! সচলে তো পারলাম না- তাই এখানেই বলে দিলাম।
    আমি সবসময় ক্যাডেট কলেজে ঢোকাটাকে আমার দ্বিতীয় জন্ম হিসেবে ধরি।
    তুমি তো জানই তোমার লেখার গুণমুগ্ধ ভক্ত আমি।

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)
    লেখাটা পড়েই বলতে চেয়েছিলাম যে অসাধারণ একটা স্মৃতিচারণ! সচলে তো পারলাম না- তাই এখানেই বলে দিলাম।

    :thumbup: :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    যতো ভালো লেখাই হউক, পুরনো হলে লেখা নিয়ে মন্তব্য করবো না ঠিক করেছি। 🙁


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      আমি নিজেও নিজের লেখা মিস করি। মাঝে ব্যস্ততাও বেড়েছে, সাথে কিছু অনাবশ্যক চিন্তা। এগুলো লেখালেখির মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমন হতো, আমাকে কিছু করতে হতো না, খালি লিখতাম আর লিখতাম, তাহলে আমার আর কিছু চাওয়ার ছিল না।

      ধন্যবাদ লাবলু ভাই! :hatsoff:

      জবাব দিন
  4. ইউসুফ (১৯৮৩-৮৯)

    অসাধারণ!

    আমার এই দ্বিতীয় জন্মস্থানকে এখন মাত্র ৩৪ কি: মি: এর মধ্যে রেখে দিন কাটাচ্ছি।

    আজ সকালেও একজন সিনিয়রকে বললাম, "চলেন না স্যার, একটু ঘুরে আসি"
    "চল যাই" - উনার প্রস্তুত উত্তর। (কলেজে যাবার কথা বললে এই উত্তরটা যে কোন এক্স ক্যাডেটের কাছেই পাওয়া যায়, সন্কোচহীনভাবে)

    এখন অপেক্ষার পালা.....একটা চাপা উত্তেজনামিশ্রিত অপেক্ষা...

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      এই চাপা উত্তেজনামিশ্রিত অনুভবটা ক--ত--দিন অনুভব করি না!! কলেজে ঢোকার সময়েই এইরকম লাগতো। সেটা সেভেনে থাকতে কিছুটা ভীতি মিশে থাকত, আর ইলেভেনে বা টুয়েলভে বদলে কেমন পজিটিভ একটা উত্তেজনা।

      হায়! স্মৃতি তুমি বেদনা...

      জবাব দিন
  5. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    ঘাই মেরে জেগে উঠলেন শীলা ম্যাডাম, আঠারো বছরে আমরা বিভ্রান্ত দুপুরে যার শাদা শাড়ির লাল পাড়ে আজও মুগ্ধ হয়ে আছি! x-( x-( x-( x-( আন্দা ভাই,ভাল হবেনা কিন্তু-উনারে আপনেদের চেয়ে আমরা বেশি পাইছি :(( :(( :((

    জবাব দিন
  6. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)
    সেই তোড়ে ভেসে এল কালো কুচকুচে আমীরুল স্যার। আমাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে যিনি নিখাঁদ স্বর্ণই বানিয়ে দিয়েছেন।

    বাবারে, পচা শামুকেও পা কাটে............... :bash: :bash:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।